Image description
সালতামামি ২০২৫ প্রশাসন

প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে বছর জুড়েই ছিল অস্থিরতা। বিদায়ী বছরে জনপ্রশাসন ছিল নানা বিতর্কে ঘেরা। কথায় কথায় বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলনের কেন্দ্রেও ছিল সচিবালয়। সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ, শীর্ষ প্রশাসনিক পদ শূন্য থাকা, বিতর্কিত চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তাদের বদলি, জেলা প্রশাসক নিয়োগ ও সচিবালয়ে অর্থ  উপদেষ্টাকে অবরুদ্ধ করা ছিল আলোচনার কেন্দ্রে।

বিদায়ী বছরের ২৪শে মে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ের কর্মচারীরা আন্দোলনে নামেন। এর আগে গত ২২শে মে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশটির খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়, যেখানে চার ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা ছাড়াই শুধু কারণ দর্শানোর নোটিশের মাধ্যমে চাকরিচ্যুত করার বিধান রাখা হয়। পরবর্তীতে ২৫শে মে অধ্যাদেশটি জারি করা হয়। সরকারি কর্মচারীরা অধ্যাদেশটিকে নিবর্তনমূলক ও ‘কালো আইন’ আখ্যা দিয়ে এর বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। এ লক্ষ্যে তারা সচিবালয়ে বিক্ষোভ মিছিল, কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। পাশাপাশি কয়েকজন উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপিও প্রদান করা হয়। এতে স্থবিরতা নেমে আসে কাজে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিভিন্ন খাতে সংস্কার কমিশন গঠন করে। এরই ধারাবাহিকতায় জনপ্রশাসন সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করা হয়।

গত ৮ই ফেব্রুয়ারি কমিশনপ্রধান প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। এতে জনপ্রশাসন কাঠামো সংস্কারে দুই শতাধিক সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনে বিদ্যমান আটটি প্রশাসনিক বিভাগের পাশাপাশি ফরিদপুর ও কুমিল্লা বিভাগ গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়। একইসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ৪৩টি থেকে কমিয়ে ২৫টিতে নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রশাসনিক কার্যক্রমকে সহজ ও সমন্বিত করতে মন্ত্রণালয়গুলোকে পাঁচটি গুচ্ছে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়। গুচ্ছগুলো হলো-বিধিবদ্ধ প্রশাসন; অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য; ভৌত অবকাঠামো ও যোগাযোগ; কৃষি ও পরিবেশ; এবং মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন।

এদিকে, গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পাশাপাশি সরকারের একাধিক দপ্তরে মাসের পর মাস সচিব পদ শূন্য ছিল। এসব দপ্তরে অতিরিক্ত সচিবরা নিয়মিত দায়িত্ব পালন করলেও সচিব না থাকায় বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকে এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েও কয়েক সপ্তাহ ধরে সচিব পদ শূন্য ছিল। যা প্রশাসনিক ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি। পরে সেখানে সচিব নিয়োগ দেয় সরকার। অন্যদিকে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন বিতর্কিত সচিবকে এক দপ্তর থেকে অন্য দপ্তরে বারবার বদলির ঘটনায় প্রশাসনে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। অন্তর্বর্তী সরকার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েকজন বিতর্কিত সচিবকে বারবার বিভিন্ন দপ্তরে পদায়ন করায় প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়ে প্রশ্ন উঠে বিভিন্ন মহলে।

গত বছরের ১৪ই অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ পান সিদ্দিক জোবায়ের। চলতি বছরের ২১শে জুলাই দুপুরে উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ২২শে জুলাই রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়। শোকাবহ এই পরিস্থিতিতে ওই দিনের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিতের দাবি ওঠে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। তবে সরকারের সিদ্ধান্ত আসে অনেক দেরিতে। ২১শে জুলাই দিবাগত রাত পৌনে ৩টার দিকে পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেয়া হয়। এই বিলম্বিত সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এরপর শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের ভেতরে ও বাইরে বিক্ষোভে নামেন এবং শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার ও সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের পদত্যাগ দাবি করেন। আন্দোলনের মুখে সেদিনই সিদ্দিক জোবায়েরকে পদ থেকে অব্যাহতি বা প্রত্যাহার করা হয়।

বিদায়ী বছরে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকসহ যুগ্ম সচিব থেকে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দিতে গত ৮ই জানুয়ারি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে সভাপতি করে ছয় সদস্যের একটি জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটি গঠন করে সরকার। পরবর্তীতে তিন দফায় এই কমিটিতে পরিবর্তন আনা হয়।

বছরের শেষদিকে এসে গত ১০ই ডিসেম্বর ২০ শতাংশ সচিবালয় ভাতার দাবিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে সচিবালয়ে টানা ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় অবরুদ্ধ করে রাখেন। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় মামলা দায়ের করে। মামলায় ১৪ জনকে গ্রেপ্তার এবং সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে। বিদায়ী বছরে সরকারি কর্মচারীদের জন্য সরকার নতুন পে-কমিশনও গঠন করেছে অন্তর্বতী সরকার। এখন প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা।

ডিসি নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে ব্যাপক রদবদল করে সরকার। গত নভেম্বরে তিন দফায় দেশের মোট ৫২টি জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে কিছু জেলায় নতুন নিয়োগ দেয়া হলেও, কোথাও কোথাও বিদ্যমান ডিসিদের অদল-বদল বা বদলি করা হয়। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বল্প সময়ে বারবার ডিসি পদে বড় পরিসরে পরিবর্তন প্রশাসনিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পতিত আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী হওয়া, দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, অতীতের বিতর্কিত নির্বাচনে সম্পৃক্ততা এবং দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া কারও কারও বিরুদ্ধে মাঠ প্রশাসনে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা না থাকার অভিযোগও সামনে আসে। নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক তীব্র হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কয়েকজন কর্মকর্তার ডিসি পদে নিয়োগ বাতিল করা হয়। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে নতুন করে আবার ডিসি নিয়োগ দেয় সরকার।