সারা দেশে বইছে ভোটের আমেজ। উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে সারা দেশে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন প্রার্থীরা। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী গতকাল সোমবার ছিল মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিন। নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা নিজ নিজ জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে তা জমা করেন। নির্বাচন কমিশন রাত ৯টার দিকে জানায়, সারা দেশে ৩০০ আসনে ২ হাজার ৫৮২ জন প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছে। এদিকে মনোনয়ন ফরম জমার শেষ দিন হিসেবে গতকাল রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়গুলো ব্যস্ত সময় পার করেছে। একের পর এক প্রার্থীরা ফরম জমা দিতে আসেন সকাল থেকেই। আর এই ব্যস্ততা চলে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। যদিও সকাল থেকে গুঞ্জন ওঠে, তফসিলে সংশোধন এনে মনোনয়ন দাখিলের সময়সীমা আরও বাড়ানো হবে। কিন্তু শেষ অবধি ইসি’র সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানান, সময় আর বাড়ানো যাবে না।
বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ফেনী-১, দিনাজপুর-৩ ও বগুড়া-৭ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঢাকা-১৭ ও বগুড়া-৬ আসনে দলীয় মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান ঢাকা-১৫ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ঢাকা-১১ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
গতকাল দিনভর দেশের দশটি অঞ্চলে ৬৪ জেলায় ৩০০ আসনেই প্রার্থীরা মনোনয়ন ফরম জমা করেন। সোমবার শেষ দিন পর্যন্ত ৩ হাজার ৪০৭ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। একই সময়ে ২ হাজার ৫৮২ জন তা জমা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে। এর মধ্যে, ঢাকা অঞ্চলে ৪১টি আসনে মনোনয়ন সংগ্রহ করেন ৬৩৮ জন। জমা দিয়েছেন ৪৪৪ প্রার্থী। রংপুর অঞ্চলের ৩৩টি নির্বাচনী এলাকায় ৩৩৮ জন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। তার মধ্যে জমা দিয়েছেন ২৭৮ জন। রাজশাহী অঞ্চলে ৩৯টি নির্বাচনী এলাকায় মনোনয়ন সংগ্রহ করেছিলেন ৩২৯ এমপি প্রার্থী। জমা দিয়েছেন ২৬০ জন। খুলনা অঞ্চলে ৩৬টি আসনে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছিলেন ৩৫৮ প্রার্থী। আর জমা দেন ২৭৬ জন। বরিশাল অঞ্চলে ২১টি নির্বাচনী এলাকায় ২১২ প্রার্থী মনোনয়ন সংগ্রহ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাখিল করেন ১৬৬ জন। ফরিদপুর অঞ্চলে ১৫টি নির্বাচনী এলাকা ১৬৫ জন সংগ্রহের বিপরীতে জমা করেন ১৪২ এমপি প্রার্থী। ময়নসিংহ অঞ্চলে ৩৮টি আসনে ৪০২ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। আর জমা দিয়েছেন ৩১১ এমপি প্রার্থী। সিলেট অঞ্চলের ১৯টি আসনে ১৭৬ জন মনোনয়ন সংগ্রহ করলে জমা করেন ১৪৬ প্রার্থী। অন্যদিকে কুমিল্লা অঞ্চলের ৩৫টি আসনে মোট সংগ্রহ করেছিলেন ৪৯৬ সংগ্রহ করার বিপরীতে ৩৬৫ প্রার্থী জমা করেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২৩টি আসনের মধ্যে ২৯৩ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলেও শেষ পর্যন্ত দাখিল করেন ১৯৪ জন প্রার্থী।
ঢাকা মহানগরে ১৩টি আসনের মধ্যে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার ও রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দেয়া ১৩টি আসনের প্রার্থীদের মধ্যে ১৭৪টি আসনে মনোনয়ন জমা পড়েছে। সবমিলিয়ে ২৫৩টি মনোনয়নপত্র গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিভাগের কমিশনার ও রিটার্নিং কর্মকর্তা শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী। সন্ধ্যায় আরেক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, ঢাকা-৪ এ আটটি, ঢাকা-৫ এ ষোলোটি ঢাকা-৬ এ সাতটি, ঢাকা-৭ এ পনেরোটি ঢাকা-৮ এ বারোটি, ঢাকা-৯ এ চৌদ্দটি ও ঢাকা-১০ এ তেরোটি, ঢাকা-১১ তে এগারোটি, ঢাকা-১২ আসনে আঠারোটি, ঢাকা-১৪ তে তেরোটি, ঢাকা-১৬ তে তেরোটি, ঢাকা-১৮তে সতেরোটিসহ মোট ১৭৪টি মনোনয়নপত্র জমা হয়েছেন। শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী এ সময় বলেন, আমরা আজকেই নির্বাচন কমিশনকে তালিকা দিয়ে দেবো। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ১ শতাংশ নাগরিকের সিগনেচারের বিষয়টি আমরা যাচাই করবো।
অন্যদিকে ঢাকা জেলার পাঁচটি আসনে ৪৪ এমপি পদপ্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে মনোনয়ন নিলেও জমা দেননি ২১ প্রার্থী। ঢাকা জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার মো. রেজাউল করিম মনোনয়নপত্র দাখিল কার্যক্রম শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান। তিনি জানান, ঢাকা-১ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন আটজন, ঢাকা-২ আসনে তিনজন, ঢাকা- ৩ আসনে ১৬ জন, ঢাকা-১৯ আসনে ১১ জন ও ঢাকা-২০ আসনে ছয়জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন।
চট্টগ্রামে ১৬টি আসন থেকে মোট ১৪৩ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। রিটার্নিং অফিসার কার্যালয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে ১০ জন, চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে ৯ জন, চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে ৫ জন, চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে ১০ জন, চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে ১০ জন, চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনে ৫ জন, চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে ৯ জন, চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে ৯ জন, চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি-বাকলিয়া) আসনে ১২ জন, চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-হালিশহর) আসনে ১১ জন, চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে ১২ জন, চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে ১১ জন, চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলি) আসনে ৯ জন, চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া) আসনে ৯ জন, চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া) আসনে ৩ জন ও চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে ৯ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
মনোনয়ন জমায় যে আমেজ দেখা গেল:
দিনভর ঢাকা জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিস ঘিরে ছিল ভোটের আমেজ। সারা দিন প্রাার্থীদের আনাগোনায় পরিপূর্ণ ছিল। সকাল থেকেই বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা ভিড় করেন সেগুনবাগিচার ১২তলা সরকারি ভবন এলাকায়। আর সড়কের বিভিন্ন স্থানে তাদের কর্মীদের জটলাও দেখা যায়। মনোনয়নপত্র জমাকে কেন্দ্র করে তাদের মাঝে উৎসব বিরাজ করে। অন্যদিকে প্রার্থীরাও কেউ কেউ জানান নিজ অনুভূতি। সেই সঙ্গে নির্বাচন নিয়েও নানা ভাবনার কথা জানান তারা।
বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে ঢাকা-১৭ আসনের মনোনয়ন জমা দেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিল সদস্য আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, আমরা আশা করি, তারেক রহমান দেশে আসার দিন ঢাকার নগরবাসী যেভাবে স্বাগত জানিয়েছেন, বরণ করে নিয়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে আগামী নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনের নাগরিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারেক রহমানকে ভোট দিবেন। তরুণ প্রজন্ম গত তিনবার ভোট দিতে পারেনি। তাই আমরা আশা করি নতুন প্রজন্ম তাদের ভোট ধানের শীষে দেবেন। নির্বাচন বা দেশ নিয়ে এখনো অনেক ষড়যন্ত্র চলছে। সেই ষড়যন্ত্রকে ভেদ করে বিএনপি এদেশের জনগণের পক্ষে কথা বলবে।
ঢাকা-৮ আসনের এনসিপি মনোনীত প্রার্থী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবিলা করেছি। এখনো ভারতীয় আধিপত্যের অনেকগুলো উপাদান রয়েছে। আমি শহীদ হওয়ার তামান্না নিয়ে এখানে (নির্বাচনে) এসেছি। আমি আগেও বলেছি আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না, এখানে অনেকেই ভয় পেয়েছে, ফলে তারা এখানে নির্বাচন করতে রাজি হয়নি। আমি চ্যালেঞ্জ নিয়েই এখানে এসেছি। যদি কখনো শহীদ হয়ে যাই আপনাদের কাছে দাবি থাকবে আপনারা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, আমি রাজনৈতিকভাবে ঢাকা-১৮ আসনের জন্য সবকিছু গুছিয়েছিলাম। কিন্তু সবাই আমাকে এই আসনে পাঠিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী ঢাকা-৮ আসন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং জায়গা। সবাই মনে করেছে আমি এটা হ্যান্ডেল করতে পারবো। তাই জোটের প্রার্থী হিসেবে আমি এখনে লড়ছি। আশা করি আমি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবো।
ঢাকা-১২ আসনে গণসংহতি আন্দোলনের তাসলিমা আখতার বলেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এই সংসদ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এই নির্বাচন আয়োজন করা হচ্ছে। নির্বাচন, বিচার, সংস্কারের পথরেখা ধরে আমরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি।
ঢাকা-৬ আসনের জামায়াত মনোনীত প্রার্থী ড. আব্দুল মান্নান বলেন, ঢাকার অবহেলিত আসন ঢাকা-৬, উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। যারা ইতিপূর্বে এই আসনে এসেছিলেন তারা মানবতার কল্যাণ করতে পারেনি। আধুনিক ঢাকা রূপান্তরের জন্য আমি কাজ করে যাবো। এই অবস্থায় ঢাকা-৬ আসনের সকলের সহযোগিতা চাই।
ঢাকা-১৫ আসনের জামায়াতের আমীর শফিকুর রহমানের পক্ষে মনোনয়ন ফরম জমা করেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসান মাহবুব জুবায়ের। তিনি বলেন, আমাদের হাতে আর ৪২-৪৩ দিন সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সর্বোত্তম পদক্ষেপ গ্রহণ করে ইসি ও সরকার আমরা সেই আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, আশা করবো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশন; তারা সবাই মিলে আমরা যাতে একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডটা নিশ্চিত করি। এক্ষেত্রে অনেক বেশি কাজ করার সুযোগ আছে। সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অবৈধ ঘোষণা অস্ত্র উদ্ধার থেকে আরম্ভ করে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার, নির্বাচনের জন্য সার্বিকভাবে একটা সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার বারবার দাবি জানিয়েছি, এখনো দাবি দিয়েছি।