দু’দিন ধরে ঢাকায় শীত জেঁকে বসেছে। ঘন কুয়াশার সঙ্গে হিমেল হাওয়া। এরই মাঝে বৃহস্পতিবার ঢাকায় নামলেন। খালি পায়ে মাটি ছুঁলেন। কিছু মাটি হাতেও নিলেন। বাবার সংগ্রামের ফসল লাল-সবুজের পতাকা আর ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে তিনি ফিরলেন। ফিরলেন বীরের বেশেই। হ্যাঁ; বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কথাই বলছি। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ঠিক ৬ হাজার ৩১৪ দিনের মাথায় তার ফেরা। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে যা এক অনন্য অধ্যায়। কেন, কী কারণে এবং কোন প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল- তা আর কারও অজানা নেই। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগ- সে ইতিহাসও এখন পুরনো। শুধু নতুন একটি প্রশ্ন সবার মনে ঘুরেফিরে ছিল গত বছরের ৫ই আগস্টের পর থেকেই। কবে দেশে ফিরছেন তারেক রহমান। রাজনীতির অন্দর মহলে যারা খবর রাখেন, তারাও উদগ্র্রীব ছিলেন তার ফেরা নিয়ে। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ছাত্র-যুবক-সাধারণ জনতা থেকে শুরু করে দলের নেতাকর্মীসহ লাখো মানুষের ভালোবাসা এবং বরণের বর্ণিল এক বিরল দৃশ্য রচিত হলো ঢাকার রাজপথে। যত মানুষ ছিল রাজপথে, তার চেয়েও লক্ষগুণ মানুষের চোখ ছিল টেলিভিশনের পর্দায়। তারেক রহমান অবশেষে ফিরলেন। অবসান ঘটলো তার প্রবাস জীবনের। কিন্তু এবার তিনি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে কী বলবেন- এমন ভাবনায় নিমজ্জিত ছিল কোটি কোটি মানুষ।
বিমানবন্দর থেকে তিনশ’ ফিটের ৩৬ এক্সপ্রেসওয়ে। জনস্রোত পেরিয়ে সাত কিলোমিটার দূরত্বের এ পথ পাড়ি দিতে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। দুপুর গড়িয়ে বিকালে সংবর্ধনা মঞ্চে উঠলেন তারেক রহমান। ১৭ বছরেরও বেশি সময় পর ১৭ মিনিটের কিছু কম সময়ের এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন তিনি। রাজনীতির ইতিহাসে এ ভাষণও একটি নজির হয়ে থাকবে। আমিত্ববিহীন এক অনন্য ভাষণের কারণে। বক্তব্য জুড়ে কোথাও কারও সমালোচনা ছিল না। বিষোদ্গার ছিল না। অতীতের চিরচেনা সেই অশ্লীল-অশ্রাব্য ভাষার ব্যবহার ছিল না। ছিল না নিজের কিংবা নিজের বাবা-মায়ের বা পরিবারের গুণকীর্তন। ভাষণের সবচেয়ে প্রশংসনীয় দিক হলো কোনো দল বা ব্যক্তির প্রতি বিষোদ্গার না করে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার বার্তা। শেখ হাসিনা তার টানা সাড়ে ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের শাসনামলে শুধুই আমিত্বময় ছিলেন। তার কথা-বার্তা, আচার-আচরণে দম্ভ এবং অহঙ্কারের প্রতিফলন ঘটেছে বারবার। শেখ হাসিনার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারাও সবসময় অশ্লীল-অশ্রাব্য ভাষায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন। তারেক রহমান একবারের জন্যও সে পথে হাঁটেননি।
তিনি তার বাবা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে দেখেছেন। তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকেও দেখেছেন। সুন্দর পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠা তারেক রহমান তার ভাষণে ভাষা প্রয়োগে বাবা-মা’র কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তার ভাষণে ছিল শান্তির কথা। ছিল ঐক্যের কথা। ছিল দেশপ্রেমের কথা। আগামী বাংলাদেশের কথা। আর ছিল দেশ এবং দেশের মানুষকে নিয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা। তারেক রহমান শান্তি, সম্প্রীতি এবং স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। ইসলামী মূল্যবোধের কথা বলেছেন। তিনি শান্তি ও সম্প্রীতির যে বার্তা দিয়েছেন, তা দেশে সুষ্ঠু ধারার রাজনৈতিক কার্যক্রমের সূচনা হিসেবে দেখা যেতে পারে। যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চান, নির্বাচনকে ভণ্ডুল করতে চান। তারেক রহমানের বক্তব্যের মধ্যদিয়ে তাদের কাছেও একটি সুস্পষ্ট বার্তা পৌঁছে গেছে। তারেক রহমান অতীতকে অস্বীকার করেননি। ’৭১ আর ’২৪-এর শহীদদের স্মরণ করেছেন। শহীদ ওসমান হাদিকে স্মরণ করেছেন। বিশেষ চেয়ার সরিয়ে বসেছেন সাধারণ চেয়ারে। এর মধ্যদিয়ে আমিত্ব বিসর্জনের নজিরও স্থাপন করেছেন।