দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বা বিআরটিএ। এ খাতে সেবা নিতে গিয়ে অন্তত ৬৩.২৯ শতাংশ নাগরিককে ঘুষ দিতে হয়েছে। বিআরটিএর পরেই রয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এখানে সেবা পেতে ৫৭.৯৬ শতাংশ মানুষকে ঘুষ দিতে হয়েছে।
গতকাল বুধবার আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনে জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিএস। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার। বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা বিভাগের সচিব এস এম শাকিল আখতার এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী।
প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩১.৬৭ শতাংশ নাগরিক গত ১২ মাসে কোনো না কোনো সরকারি সেবা নিতে গিয়ে সরাসরি ঘুষ দিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন।
জরিপে নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিরাপত্তা, সুশাসন, সরকারি সেবার মান, দুর্নীতি, ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার এবং বৈষম্যবিষয়ক এসডিজি ১৬-এর ছয়টি সূচকের অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হয়েছে। জাতীয়ভাবে নমুনাভুক্ত খানার মধ্যে গড়ে সদস্যসংখ্যা ৪.০০ জন, যার মধ্যে ৮১.৯৭ শতাংশ পুরুষপ্রধান পরিবার এবং ১৮.০৩ শতাংশ নারীপ্রধান পরিবার।
জরিপে দেখা যায়, দেশের ৮৪.৮১ শতাংশ নাগরিক সন্ধ্যার পর নিজ বাসার আশপাশের এলাকায় একা চলাফেরা করতে নিরাপদ বোধ করেন। এই নিরাপত্তাবোধ পুরুষদের মধ্যে ৮৯.৫৩ শতাংশ। এর তুলনায় নারীদের ৮০.৬৭ শতাংশ। সন্ধ্যার পর নিজ বাড়িতেই বেশি নিরাপত্তা বোধ করেন ৯২.৫৪ শতাংশ মানুষ।
জরিপ বলছে, মাত্র ২৭.২৪ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, তাঁরা সরকারি সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারেন। রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে এই হার আরো কমে ২১.৯৯ শতাংশে নেমে আসে। জাতীয়ভাবে প্রায় এক-চতুর্থাংশ বা ২৪.৬২ শতাংশ জনগণ মনে করেন, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সাড়াপ্রবণ। এ বিষয়ে পল্লী এলাকায় ২৪.৪৭ শতাংশ ও শহরের ২৪.৯১ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মতামত প্রায় একই রকম।
গত ১২ মাসে সরকারি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, জাতীয়ভাবে ৪৭.১২ শতাংশ জনগণ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া ৪০.৯৩ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তাঁদের অন্তত একটি সন্তান সরকারি বিদ্যালয়ে (প্রাথমিক/মাধ্যমিক) পড়াশোনা করেছে। তদুপরি ৭৩.৭৭ শতাংশ জনগণ অন্যান্য সরকারি সেবা (পরিচয়পত্র/নাগরিক নিবন্ধন) গ্রহণের অন্তত একটি প্রচেষ্টা করেছেন। এই সেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে পাঁচটি সেবার ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবায় সামগ্রিক সন্তুষ্টির হার ৭২.৬৯ শতাংশ, প্রাথমিক শিক্ষায় ৮১.৫৬ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ৭৮.১৮ শতাংশ এবং অন্যান্য সরকারি সেবায় (পরিচয়পত্র/নাগরিক নিবন্ধন) ৬৬.৯১ শতাংশ সন্তুষ্টি হার রিপোর্ট করা হয়েছে।
জরিপ অনুযায়ী, গত ১২ মাসে যাঁরা সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তাঁদের মধ্যে জাতীয়ভাবে গড়ে ৩১.৬৭ শতাংশ ঘুষ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে জেলা পর্যায়ে এই হার অনেক ক্ষেত্রে গড়ের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ঘুষ দেওয়ায় শীর্ষে নোয়াখালী। এখানে সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগকারী নাগরিকদের ৫৭.১৭ শতাংশ ঘুষ দিয়েছেন। তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে কুমিল্লা (৫৩.৪৭ শতাংশ)। এরপর ফরিদপুর (৫১.৭০ শতাংশ), ভোলা (৪৯.০১ শতাংশ) ও সিরাজগঞ্জ (৪৮.৩৭ শতাংশ)। এসব জেলায় ঘুষ প্রদানের হার জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক বেশি।
অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে কম ঘুষ দেওয়া জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এখানে ঘুষ দেওয়ার হার ১০.৪৯ শতাংশ। এরপর মাগুরা (১৩.৯৮ শতাংশ), লালমনিরহাট (১৪.৫০ শতাংশ), গাজীপুর (১৫.২৪ শতাংশ) ও সিলেট (১৫.৬১ শতাংশ)। এই পাঁচ জেলায় ঘুষ দেওয়ার হার জাতীয় গড়ের অনেক নিচে।
আয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ আরো ভিন্ন এক বাস্তবতা সামনে এনেছে। জরিপে দেখা যায়, সবচেয়ে ধনী শ্রেণির ৩৫.১৬ শতাংশ মানুষ ঘুষ দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে দরিদ্র শ্রেণিতে এই হার ২৫.৯২ শতাংশ। মধ্যম আয়ের ক্ষেত্রে ঘুষ দেওয়ার হার ৩২.২৪ শতাংশ এবং উচ্চ-মধ্যম আয়ের ক্ষেত্রে ৩৩.৬০ শতাংশ। অর্থাৎ আয়ে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুষ দেওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।
এই তথ্য সাধারণ ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। প্রচলিতভাবে মনে করা হয়, দরিদ্র জনগোষ্ঠীই বেশি ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু বিবিএসের জরিপ বলছে, উচ্চ আয়ের মানুষ সরকারি কাজ দ্রুত করাতে বা সুবিধা নিশ্চিত করতে তুলনামূলকভাবে বেশি ঘুষ দিচ্ছেন অথবা তাঁদের কাছ থেকেই বেশি ঘুষ নেওয়া হচ্ছে। ফলে দুর্নীতি কেবল দারিদ্র্যজনিত সমস্যা নয়, এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও আচরণগত সংকট হিসেবেই স্পষ্ট হচ্ছে। জাতীয়ভাবে প্রায় ১৬.১৬ শতাংশ জনগণ গত দুই বছরে বিভিন্ন বিবাদ বা বিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশ (৮৩.৬০ শতাংশ) জনগণ বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আনুষ্ঠানিক (যেমন-আদালত) অথবা অনানুষ্ঠানিক (যেমন-কমিউনিটি নেতা) কোনো না কোনো ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার পেয়েছে। এর মধ্যে ৪১.৩৪ শতাংশ আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এবং ৬৮.৯৬ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেবা পেয়েছে।
ফলাফল অনুযায়ী দেশের ১৯.৩১ শতাংশ জনগণ কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্যের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। বৈষম্যের প্রধান ভিত্তি ছিল আর্থসামাজিক অবস্থা (৬.৮২ শতাংশ) এবং লিঙ্গ (৪.৪৭ শতাংশ)। বৈষম্যের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে নিজের পরিবারের মধ্যে (৪৯.৭২ শতাংশ), গণপরিবহন/উন্মুক্ত স্থানে (৩৪.৮২ শতাংশ) এবং কর্মস্থলে (২৪.৮৫ শতাংশ)। মাত্র ৫.৩৭ শতাংশ ভুক্তভোগী এসব ঘটনার বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করেছেন।
বিবিএস জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে দেশের ৬৪ জেলার ৪৫ হাজার ৮৮৮টি খানা থেকে ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী ৮৪ হাজার ৮০৭ জন নারী-পুরুষ এই জরিপে অংশ নেন। নাগরিকদের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে নিরাপত্তা, সুশাসন, সরকারি সেবার মান, দুর্নীতি, ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার ও বৈষম্য এসডিজি ১৬-এর ছয়টি লক্ষ্যের অগ্রগতি মূল্যায়নে এই জরিপ পরিচালিত হয়।