Image description
বিবিএস’র সিপিএস জরিপ

সরকারি সেবা নিতে এক বছরে ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ নাগরিককে ঘুস দিতে হয়েছে। পুরুষদের মধ্যে ঘুস দেওয়ার হার ৩৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে ২২ দশমিক ৭১ শতাংশ। এদিকে সবচেয়ে বেশি (৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ) দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিআরটিএ। এরপরই রয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ৫৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং পাসপোর্ট অফিস ৫৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এছাড়া প্রায় ৯৮ দশমিকের ৪৮ শতাংশ মানুষ ঘুস হিসাবে ‘টাকা’ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস) ২০২৫-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনের সম্মেলন কক্ষে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে বিবিএস। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা সচিব শাকিল আখতার এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাসুদ রানা চৌধুরী। বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিটিজেন পারসেপশন সার্ভের প্রকল্প পরিচালক রাশেদ-ই-মাসতাহাব। প্রশ্নোত্তর পর্ব পরিচালনা করেন এসডিজির ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘুস দেওয়ার শীর্ষে রয়েছেন নোয়াখালী জেলার মানুষ। এরপর পর্যায়ক্রমে কুমিল্লা, ফরিদপুর, ভোলা এবং সিরাজগঞ্জ জেলার মানুষ। সবচেয়ে কম ঘুস দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পার্বত্য জেলা, লালমানিরহাট, গাজীপুর এবং সিলেটের মানুষ। এদিকে বিবিএস বলেছে, এক বছরে কমপক্ষে একটি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ৫১ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে শহরে এই হার ৫২ দশমিক ৩২ এবং গ্রামে ৫০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এছাড়া পুরুষদের মধ্যে ৬১ দশমিক ৪৩ এবং নারী ৪১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আরও বলা হয়েছে, জাতীয়ভাবে প্রায় ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ মানুষ গত দুবছরে কোনো না কোনো বিবাদ বা বিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশ (৮৩ দশমিক ৬০ শতাংশ) মানুষ বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আনুষ্ঠানিক (যেমন : আদালত) প্রতিষ্ঠানে গেছেন। 

প্রকাশনা অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বিবিএস এ বছরের ৬-২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশব্যাপী ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস)’ পরিচালনা করে। ৬৪ জেলার ১ হাজার ৯২০টি প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট থেকে ৪৫ হাজার ৮৮৮টি খানা বা পরিবার থেকে ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সি মোট ৮৪ হাজার ৮০৭ জন উত্তরদাতার সাক্ষাৎকার নেন। এর মধ্যে পুরুষ ৩৯৮৯৪ এবং নারী ৪৪৯১৩ জন। জরিপে নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিরাপত্তা, সুশাসন, সরকারি সেবার মান, দুর্নীতি, ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার এবং বৈষম্যবিষয়ক এসডিজি ১৬-এর ছয়টি সূচকের অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হয়েছে। জরিপের প্রশ্নপত্র জাতিসংঘের নির্ধারিত আন্তর্জাতিক মান ও পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি করা হয়। 

জরিপে দেখা গেছে, ১৫ দশমিক ১৯ শতাংশ মানুষ নিজ বাড়ির আশপাশে সন্ধ্যার পর চলাফেরা করতে ভয় পায়। এছাড়া দেশের ৮৪ দশমিক ৮১ শতাংশ নাগরিক সন্ধ্যার পর নিজ বাসার আশপাশে একা চলাফেরা করতে নিরাপদবোধ করেন। এ নিরাপত্তাবোধ পুরুষদের ৮৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং নারীদের ৮০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সন্ধ্যার পর নিজ বাড়িতে নিরাপত্তাবোধের হার তুলনামূলকভাবে বেশি ৯২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

সুশাসনের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৭ দশমিক ২৪ শতাংশ নাগরিক মনে করেন তারা সরকারি সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারেন। তবে সরকারি যে কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রভাব ফেলতে পারেন না ৭২ দশমিক ৭৬ শতাংশ মানুষ। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে ২১ দশমিক ৯৯ শতাংশ মানুষ ভূমিকা রাখতে পারেন। বিপুলসংখ্যক মানুষ সেটি পারেন না। তবে জাতীয়ভাবে প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৪ দশমিক ৬২ শতাংশ) জনগণ মনে করেন, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সাড়াপ্রবণ। কিন্তু ৭৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ মানুষ সেটি মনে করেন না। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছরে ১৯ দশমিক ৩১ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্য বা হয়রানির শিকার হয়েছে। এর প্রধান কারণ ছিল আর্থ-সামাজিক অবস্থার জন্য ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং লিঙ্গের কারণে ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। তবে সবচেয়ে বেশি ৪৯ দশমিক ৭২ শতাংশ বৈষম্যের ঘটনা ঘটেছে নিজ পরিবারে। এরপর গণপরিবহণ বা উন্মুক্ত স্থানে ৩৪ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং কর্মস্থলে ২৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ। তবে ৯৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ মানুষই এসব বৈষম্য বা হয়রানির বিষয়ে কোথাও অভিযোগ করেননি। মাত্র ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ মানুষ কোথাও না কোথাও অভিযোগ করেছেন। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না বলে তারা অভিযোগও করেন না। 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত ১২ মাসে সরকারি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, জাতীয়ভাবে ৪৭ দশমিক ১২ শতাংশ জনগণ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন। এছাড়া ৪০ দশমিক ৯৩ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তাদের অন্তত একটি সন্তান সরকারি বিদ্যালয়ে (প্রাথমিক/মাধ্যমিক) পড়াশোনা করেছে। ৭৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ জনগণ অন্যান্য সরকারি সেবা (পরিচয়পত্র/নাগরিক নিবন্ধন) গ্রহণের অন্তত একবার চেষ্টা করেছেন। এ সেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে পাঁচটি মাত্রার ভিত্তিতে দেখা যায় যে, স্বাস্থ্যসেবায় সামগ্রিক সন্তুষ্টির হার ৭২ দশমিক ৬৯ শতাংশ, প্রাথমিক শিক্ষায় ৮১ দশমিক ৫৬ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ৭৮ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং অন্যান্য সরকারি সেবায় (পরিচয়পত্র/নাগরিক নিবন্ধন) ৬৬ দশমিক ৯১ শতাংশ সন্তুষ্ট। 

প্রধান অতিথির বক্তব্যে আলেয়া আক্তার বলেন, এ প্রতিবেদনে উঠে আসা তথ্যগুলো যদি সরকারি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজে লাগানো যায় তাহলে এটি তৈরির উদ্দেশ্য সফল হবে। কেননা এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসছে। এগুলো আমাদের আর্থ-সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থা বুঝতে সহায়তা করবে। 

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শাকিল আখতার বলেন, সুশাসন নিশ্চিত করতে সমস্যা হচ্ছে। আমরা দুর্বৃত্তায়নের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। দেশে আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। এ দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের অবস্থা খুই খারাপ। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, প্রকল্প বাস্তবায়ন মনিটরিং করার জন্য আলাদা প্রকল্প নিতে হবে।