ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি পুরোদমে এগিয়ে চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সারাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করছেন। নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রশাসন, আইশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তথা অংশীজনদের সাথে বৈঠক করে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করছেন। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বানচালের জন্য দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। দেশের ভেতরে একটি গোষ্ঠী যেমন নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা করছে, তেমনি বাইরেও বেশ কয়েকটি দেশ নির্বাচন বানচালের চক্রান্ত করছে। বড় ধরনের নাশকতা করে দেশকে অস্থিতিশীল করে নির্বাচন বানচাল করতে তারা তৎপর রয়েছে। তবে সব ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবিলা করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে সরকার ও নির্বাচন কমিশন বদ্ধপরিকর।
বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। বিশেষ করে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদিকে রাজধানীতে প্রকাশ্যে দিবালোকে গুলি করার পর প্রার্থীদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও কিছুটা ভয় এবং আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। তবে এমন ভয় বা আতঙ্ক প্রার্থী বা সাধারণ ভোটার কারো মধ্যে থাকবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ডাক বিভাগের অফিস পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ভোট উৎসব হবে। চিন্তা করবেন না, ভয় কেটে যাবে। ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের এখন আস্থা আসবে। আপনারা দেখবেন সময় আসুক। আমরা দেশবাসী, বড় রাজনৈতিক দলসহ সবাই তো ইলেকশন চায়, সবাই দেশের মঙ্গল চায়, ভোটাররাও চায়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভয়-বাধাহীন পরিবেশে উৎসবমুখর একটি নির্বাচনের প্রত্যাশা আবারও ব্যক্ত করেছেন। গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ভোটের গাড়ির সুপার ক্যারাভানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, আমরা এমন একটি নির্বাচন চাই, যেখানে ভয় থাকবে না, বাধা থাকবে না, থাকবে শুধু জনগণের মুক্ত ও নির্ভীক মতপ্রকাশ। সরকার সেই উৎসবমুখর পরিবেশ নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পরিবেশ সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর করতে নির্বাচনের জন্য তিন লাখ সেনাবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। এক লাখ মাঠে আছে বাকি এক লাখ এখন মাঠে নামবে এবং নির্বাচনের ৫ দিন আগে এক লাখ নামবে। ম্যাজিস্ট্রেসি ও অস্ত্র উদ্ধার, কমান্ড সেলের কাজ থাকবে, সার্বিক বিষয় এবং টেকনিক্যাল সব বিষয়ে প্রস্তুত আছে তারা। মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, ডেভিল হান্ট অপারেশন পরিচালনা ও সার্বিক বিষয়ে কর্মতৎপরতা রেখে মানুষের মাঝে ভয় ও সংকট কাটিয়ে তুলতে কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ছাড়া নির্বাচনে মাঠপর্যায়ে নিরাপত্তা জোরদার করতে প্রায় ৪০ হাজার পুলিশ বডি ক্যামেরাসহ দায়িত্ব পালন করবে।
ভোটের নজরদারিতে সব কেন্দ্রে থাকবে সিসি ক্যামেরা। ইসি সূত্র জানায়, শুরুতে নির্বাচন ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কায় ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের বিষয়ে কমিশন আগ্রহী ছিল না। তবে মাঠপর্যায়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে আগে থেকেই সিসি ক্যামেরা আছে। সেগুলো সচল রাখা গেলে অতিরিক্ত ব্যয় তেমন বাড়বে না। আর যেসব কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা নেই, সেখানে কেবল ভোটের দিনের জন্য অস্থায়ীভাবে ক্যামেরা বসানো হবে। এতে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা বাড়বে, ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং কোনো ধরনের অপরাধ ঘটলে ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দ্রুত অপরাধী শনাক্ত করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন।
আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে গত ২১ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন ভবনে তিন বাহিনীর প্রধানদের সাথে বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন। এই বৈঠক শেষে ইসি মাঠপর্যায়ে তিনটি নির্দেশনা দিয়েছে। এর প্রথমটি হলো, নির্বাচনের পরিবেশ কোনোভাবে নষ্ট করে এমন কোনো কর্মকা- সহ্য করা হবে না। জনমনে ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে এমন কর্মকা- নিরুৎসাহিত করা ও বাধা দেয়ার জন্য যা যা করা দরকার তা করা হবে। জনমন থেকে ভয়-সংকট দূর করতে মাঠপর্যায়ে যেভাবে কাজ করা দরকার তা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো, গোয়েন্দাদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে ভবিষ্যতে হাদির মতো কোনো ঘটনা যেন না ঘটে এ জন্য আগে থেকে সব তথ্য সংগ্রহ করে প্রস্তুতি রাখা। দরকার হলে মাঠপর্যায়ে সোর্সের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। তৃতীয়টি হলো, মাঠপর্যায়ে যৌথবাহিনী অপারেশন ও অস্ত্র উদ্ধার এবং ভোটারদের আস্থা অর্জন করার জন্য কাজ করা। যেসব এলাকা দূরবর্তী সেখানে নানা অভিযান ও টহল জারি রাখা। প্রত্যেক এলাকায় চেকপোস্ট রাখার জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির লক্ষ্যে যৌথবাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছে। গত ১৩ ডিসেম্বরের পর থেকে যৌথবাহিনী বিশেষ অভিযানে সারাদেশে ১৫৬টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে, এক হিসাবে প্রতিদিন ২ জন করে আটক হচ্ছে এবং অবৈধ ২ হাজার মোটরসাইকেল ও গাড়ি আটক হয়েছে।
প্রার্থীদের মধ্যে নিরাপত্তার শঙ্কা দূর করতে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সরকার। জুলাই যোদ্ধা, সমন্বয়ক ও সংসদ সদস্যপ্রার্থী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সম্মুখসারির কয়েকজনকে গানম্যান দেওয়া হয়েছে। তাদের ব্যক্তিগত অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই তালিকায় রয়েছেন: অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা ও মুখ্য সমন্বয়ক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানকেও গানম্যান দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকজন রাজনীতিক ও সংসদ সদস্যপ্রার্থী গানম্যান ও অস্ত্রের লাইসেন্স চেয়ে আবেদন করেছেন। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (জেপি) প্রধান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাছে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য গানম্যান চেয়েছেন। আবেদনের ভিত্তিতে কয়েকজন রাজনীতিককে গানম্যানসহ অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে শিগগিরই। এদের মধ্যে রয়েছেন-গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি, ডেমরা-যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে বিএনপি মনোনীত সংসদ সদস্যপ্রার্থী তানভির আহমেদ রবিন, পাবনা-৩ আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হাসান জাফির তুহিন, জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদসহ আরো বেশ কয়েকজন। এছাড়া ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার থাকা শহীদ ওসমান হাদির পরিবারকে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ নিরাপত্তা। হাদির এক বোন পাচ্ছেন লাইসেন্স এবং গানম্যান। অন্য সদস্যদের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা। পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসররা দেশে এবং বিদেশে বসে নির্বাচন বানচালে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক প্রতিবেদনে তথ্য তুলে ধরে সরকারকে অবহিত করা হয়েছে। জুলাই যোদ্ধারা শেখ হাসিনার পতনের দিন গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকেই নানা ধরনের হুমকির মুখে আছেন। দেশে আত্মগোপনে থাকা বা বিদেশে পলাতক নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগসহ তাদের দোসররা জুলাই যোদ্ধাদের প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছে। ভারতে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দলের লোকজনকে উসকে দিচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদিকে হত্যা করা হবে বলে গত কয়েক মাস ধরে বিদেশি নম্বর থেকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তাকে ১২ ডিসেম্বর হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়। দেশ-বিদেশে উন্নত চিকিৎসা দিয়েও হাদিকে বাঁচানো যায়নি। হাদির শাহাদাতের মধ্য দিয়ে সরকারের এই উপলব্ধি এসেছে যে, জুলাই যোদ্ধাদের যতটুকু সম্ভব নিরাপত্তা দিতে হবে। হাদির মতোই জীবনঝুঁকির তালিকায় আছেন এবি পার্টির ব্যারিস্টার ফুয়াদ, জুলাই যোদ্ধা ও সমন্বয়ক এনসিপির হাসনাত আবদুল্লাহসহ সম্মুখ সারির অনেক যোদ্ধা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত রাজনীতিকরা। তাদের প্রতিনিয়ত হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি সরকারের গোয়েন্দা তথ্যেও রয়েছে।
প্রার্থীদের নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, নির্বাচনে কোনো এলাকায় প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা থাকলে তাদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে এবং পুলিশের মাধ্যমে তাদের নিরাপত্তা দেয়া হবে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে দায়িত্ব পালন করবে। আমরা আশা করি আগামী নির্বাচন হবে ভয়-ভীতিহীন পরিবেশে, অবাধ ও উৎসবমুখর।
এদিকে সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের বিষয়ে ভোটারদের সচেতন করতে সারাদেশে প্রচারের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছে ১০টি ভোটের গাড়ির সুপার ক্যারাভান। গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে সুপার ক্যারাভান। এসব গাড়ি দেশের ৬৪টি জেলা ও ৩০০টি উপজেলায় ঘুরে বেড়াবে। তারা মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে নির্বাচন ও গণভোট সম্পর্কে তথ্য পৌঁছে দেবে, ভোটাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করবে এবং গণতন্ত্রের বার্তা ছড়িয়ে দেবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আমরা কিন্তু প্রথম থেকেই বলছি, নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হবে এবং উৎসবমুখর হবে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে প্রস্তুতি গ্রহণের কথা বলেছেন। একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন এই সরকার তা নিচ্ছে।