নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে সারা দেশের মানুষ। চাঁদাবাজি ছাড়াও একের পর এক খুন, হামলা, ছিনতাই, দখলবাজি ও লুটপাট চলছেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোরতা কতটা আছে সেই প্রশ্নও উঠেছে নানা মহলে।
সর্বশেষ গতকাল বেলা পৌনে ১২টায় খুলনার সোনাডাঙ্গায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শ্রমিক সংগঠনের বিভাগীয় আহ্বায়ক মোতালেব সিকদারের মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালায় দুর্বৃত্তরা। গুরুতর অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর বিজয়নগরে ব্যাটারিচালিত একটি অটোরিকশায় একটি মোটরসাইকেলে আসা দুই হামলাকারী গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির মাথায় গুলি করে। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ ডিসেম্বর জনপ্রিয় যুবনেতা শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরে দেশজুড়ে একাধিক স্থানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ১৯ ডিসেম্বর গভীর রাতে লক্ষ্মীপুরে দরজায় তালা লাগিয়ে ও পেট্রল ঢেলে বেলাল হোসেন নামের এক বিএনপি নেতার ঘরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় ঘরের ভিতর আগুনে পুড়ে ওই বিএনপি নেতার সাত বছর বয়সি এক মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ওই বিএনপি নেতা এবং তাঁর আরও দুই মেয়ে আগুনে দগ্ধ হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র বলছে, ঢাকায় ভাসমান ও ছদ্মবেশী অপরাধীরা এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। এরা মূলত অপরাধ করে সরে পড়ে। ঠিকানাবিহীন এসব অপরাধী যেকোনো ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে নির্বিঘ্নে কেটে পড়ে। এদের শনাক্ত করতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে। দুই বছর আগে ঢাকায় ৬ হাজারের বেশি অপরাধীকে ডেটাবেসে যুক্ত করা হয়েছিল। তবে ভাসমান ও ছদ্মবেশী অপরাধীদের ডেটাবেসের আওতায় আনা হয়নি কখনো।
জানা যায়, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বড় শহরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল বাড়ানো হয়েছে। থানাভিত্তিক সন্ত্রাসীদের হালনাগাদ তালিকা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের আইনের আওতায় আনতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক এ প্রতিবেদককে বলেন, সাধারণ অভিযান চালিয়ে অস্ত্রধারীদের দমন করা সম্ভব নয়। যৌথ বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযান চালাতে হবে। মাঠপর্যায়ে অস্ত্রধারীদের সঙ্গে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদেরও গ্রেপ্তার করতে হবে। অপরাধ দমনে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সমাজের সচেতনতা বাড়াতে হবে। পুলিশি ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করতে হবে, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে গণপিটুনির শিকার হয়ে ১০৩ জন নিহত হয়েছেন। আর ঢাকা বিভাগেই নিহত হয়েছেন ৫১ জন। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৯২টি। রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে ২৮৮টি। এতে মারা গেছেন ৭৩ জন।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে ১ হাজার ৯৩০ জন খুন হয়েছেন এবং এর মধ্যে জুন মাসে দেশে সর্বোচ্চ ৩৪৩ জন খুন হয়েছেন। এই সময়ে সারা দেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬৬টি।
ডিএমপির হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ছয় মাসে ঢাকা মহানগরের ৫০ থানায় ৩৩টি ডাকাতি, ২৪৮টি ছিনতাই, ১২১টি খুন এবং ১ হাজার ৬৮টি চুরির মামলা হয়েছে। এ ছাড়া মাসে ৭০টি চাঁদাবাজির মামলাও হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ পুলিশ সারা দেশে সমন্বিত ও বহুমাত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অপরাধপ্রবণ এলাকায় বিশেষ অভিযান, টহল ও চেকপোস্ট জোরদার করা হয়েছে। একই সঙ্গে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি, অপরাধী ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের তালিকা হালনাগাদ, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং টার্গেটেড গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। পুলিশ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে এবং যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা কঠোরভাবে দমন করা হবে।