Image description

জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় রয়েছে সাতজনের কবর। তাদের সবাই স্বাধীন বাংলাদেশের অথবা অবিভক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্য ছিলেন। একই স্থানে দাফন করার জন্য জুলাইযোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির নাম আলোচনায় এসেছে।

সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদিকে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় দাফন করা হতে পারে বলে সরকারঘনিষ্ঠ একটি সূত্র স্ট্রিমকে জানিয়েছে। দাফনের স্থান নির্দিষ্ট করতে এরইমধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল শুক্রবার সংসদ ভবন এলাকা পরিদর্শন করেছে।

গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট সড়কে ওসমান হাদিকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পরে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল ঘুরে গত সোমবার তাঁকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ওসমান হাদির মৃত্যু হয়।

আজ সন্ধ্যায় কফিনে ওসমান হাদি দেশে এসেছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাঁকে নিয়ে রাখা হয়েছে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের হিমঘরে। সেখান থেকে আগামীকাল শনিবার বেলা ২টা সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ওসমান হাদির নামাজে জানাজা হবে বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে।

অবশ্য পরিবারের বরাত দিয়ে ইনকিলাব মঞ্চ ওসমান হাদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ লাগোয়া জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পাশে কবর দেওয়ার কথা জানিয়েছে। যদিও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

দক্ষিণ প্লাজায় যাদের কবর রয়েছে, তারা হলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার, সাবেক সংসদ সদস্য খান এ সবুর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়া, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমেদ এবং সাবেক স্পিকার তমিজউদ্দীন খান।

তাদের মধ্যে বিচারপতি আবদুস সাত্তার ছিলেন বাংলাদেশের অষ্টম রাষ্ট্রপতি। ১৯৮১ সালের নভেম্বরে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন। একই বছরের ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৬৬ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি নির্বাচিত হন। তবে ১৯৮২ সালে তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরপর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশ– উভয় আমলেরই রাজনীতিবিদ ছিলেন খান এ সবুর। তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য এবং আইয়ুব খানের সময়ে যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশেও তিনি সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন।

সংসদ ভবন এলাকায় সমাহিত আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান। তিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কুষ্টিয়া অঞ্চল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন শাহ আজিজুর রহমান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে ওঠেন।

পূর্ব-পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের কবরও রয়েছে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়। তিনি ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

সংসদ ভবন এলাকায় শায়িত আছেন মশিউর রহমান, যিনি যাদু মিয়া নামে বেশি পরিচিত। তিনি স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী রাজনীতিক ও সাবেক মন্ত্রী। ন্যাপের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা মশিউর রহমান পরে বিএনপিতে যোগ দেন।

এ ছাড়া এখানে সমাহিত আছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ আবুল মনসুর আহমেদ। বাংলা সাহিত্যে ব্যঙ্গধর্মী রচনার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। পাকিস্তান আমলে তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।

সংসদ ভবন এলাকায় সমাহিতদের তালিকায় রয়েছেন তমিজউদ্দীন খানও। তিনি অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী, পাকিস্তান সংবিধান সভার প্রেসিডেন্ট এবং জাতীয় পরিষদের স্পিকার ছিলেন। এর বাইরে সংসদ ভবনের উত্তর প্লাজায় রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর। ১৯৮০ সালের ৩০ মে নিহত হলে তৎকালীন সরকার তাঁকে এখানে সমাহিত করে। উত্তর প্লাজায় চন্দ্রিমা উদ্যানের ভেতর প্রায় ৫ বিঘা জমিতে রয়েছে সাবেক এ রাষ্ট্রপতি সমাধি কমপ্লেক্স।

এদিকে, ২০১৫ সালে জিয়াউর রহমানের এবং দক্ষিণ প্লাজায় থাকা সাতজনের কবর সরিয়ে নেওয়ার আলোচনা শুরু করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কবরগুলো সরিয়ে নিতে ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই একটি প্রস্তাব তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও পাঠায়। তবে শেষ পর্যন্ত সেটি আর কার্যকর হয়নি।

আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের কণ্ঠস্বর ওসমান হাদিকে নিয়ে আলোচনার বাস্তবায়ন হলে তিনিই হবেন রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা প্রথম ব্যক্তি, যিনি সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার কবরে ঠাঁই পাবেন।