Image description

আওয়ামী লীগ জমানায় দুর্দণ্ড প্রতাপশালী ছিল সীমান্ত জনপদ জকিগঞ্জের সুমন মেম্বার। হাতে থাকতো আগ্নেয়াস্ত্র। আর এই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে নিজেকে জাহির করেছিলেন প্রতাপশালী হিসেবে। পূর্ব সিলেটের সীমান্ত ব্যবসার এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে সুমন মেম্বারের আধিপত্য ছিল না। চোরাই চিনির ব্যবসার অধিপতি ছিল সে। তার সিন্ডিকেটের মারফতে আসে অস্ত্র, ইয়াবার বড় বড় চোরাচালান। সুমন মেম্বারের পুরো নাম সুমন আহমদ চৌধুরী। বাড়ি জকিগঞ্জের বারহাল ইউপি’র নুরনগরে। দুই যুগ আগে থেকে এলাকার অপরাধের নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। ডাকাতি, সন্ত্রাসী ও রাহাজানিতে ছিল তার নাম। তখন সে ছিল জকিগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই বদলে যায় সুমনের ভাগ্য।  গোটা জকিগঞ্জের তীর ও জুয়ার অধিপতি হয়ে উঠে। পুলিশ ছিল ম্যানেজ। বখরা পেতো নিয়মিত। এ কারণে সুমনের নামেই চলতে জুয়ার আসর। ধীরে ধীরে জকিগঞ্জে সীমানা ছাড়িয়ে পাশ্বর্বর্তী কানাইঘাটে তার নিয়ন্ত্রণ। পাশে নিরাপদ সীমান্ত রুট কানাইঘাটের আলোচিত ডোনা। ফলে ডোনা, আটগ্রামসহ কয়েকটি সীমান্তে  চোরাচালানের নিয়ন্ত্রণ নেয়া শুরু করে। আওয়ামী লীগ জমানায় জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে যেসব গরু ও মহিষ ও কসমেটিক্সের চালান আসতো সবাই তার হাত ছুঁয়ে যেতো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এতে করে কাঁচা টাকার মালিক বনে যায় সুমন। প্রায় ১২ বছর আগে বারহাল ইউপি নির্বাচনে মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। অনেকটা জোরপূর্বকই জয়লাভ করে। দলীয় প্রভাব ও টাকার জোরে এলাকায় হয়ে উঠে ‘ভয়ঙ্কর’ ব্যক্তি। জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট পর্যন্ত তার ক্ষমতার বিস্তৃতি। 

সিলেট নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিনের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত ছিল সে। ফলে দুই উপজেলার প্রশাসনে একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠে।  ডোনা সীমান্ত এলাকার লোকজন জানিয়েছেন- সুমন মেম্বার ডোনা সীমান্ত দিয়ে গরু, মহিষের চালান নিয়ে আসতো। তার সঙ্গে আসতো আগ্নেয়াস্ত্র ও ইয়াবার চালান। ২০১৮ সালের পরবর্তী সময়ে জকিগঞ্জ ও সিলেটে মরণ নেশা ইয়াবার কয়েকটি বড় চালান আটকের ঘটনা ঘটে। এসবের চালান আটক হওয়ার পর যে নামটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় সেটি ছিল সুমন মেম্বারের। তাকে নিয়ে ওই সময় অস্থির ছিল ডিবি পুলিশ। আগ্নেয়াস্ত্রসহ ছবি ভাইরাল হওয়ার পর ডিবি পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তবে গ্রেপ্তারের কয়েক মাসের মধ্যে বেরিয়ে আসে মেম্বার। এরপর প্রার্থী হয় বারহাল ইউপি নির্বাচনের চেয়ারম্যান পদে। ওই নির্বাচনে ব্যালট হয় এক নির্বাচনী কর্মকর্তা আটক হয়েছিলেন। তখন ব্যালট গুনে দেখা গিয়েছিল আটককৃত ব্যালটের মধ্যে সুমনে ঘোড়া প্রতীকের ব্যালট বেশি ছিল। ফলে তাকে ঘিরে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতির ঘনিষ্ঠজন হওয়ার কারণে সুমন সিলেট মহানগর যুবলীগের কমিটিতে সদস্য ছিল সে। চিনি, গরু ও মহিষ চোরাচালানে একের পর এক বিতর্কিত ঘটনার ঘটানোর পর এলাকা ছেড়ে সে অবস্থান নেয় শহরতলীর দাশপাড়া এলাকায়। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে জকিগঞ্জ রুটে প্রায় অর্ধকোটি টাকা মূল্যের একটি চিনির চোরাচালান ধরা পড়ে। ওই চালানের সঙ্গে সুমন মেম্বারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ায় সে এলাকায় যাওয়া আসা কমিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে কর্তৃত্ব নেয়া শুরু করে পূর্ব সিলেটের চোরাচালান রাজ্য হরিপুরের। 

সেখানের চোরাচালানীসহ কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় চোরাচালানের মালামাল পাঠানো শুরু করে। গড়ে তোলে নতুন সিন্ডিকেট। নগরের টিলাগড় কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের একটি গ্রুপের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা বাড়ায়। দাশপাড়া এলাকার স্থানীয় লোকজন জানান- সুমন মেম্বার দাশপাড়ায় অবস্থান নেয়ার পর শাহপরান বাইপাসসহ কয়েকটি এলাকা চিনি চোরাচালানের হেডকোয়ার্টারে পরিণত হয়।  মেট্রো ডিবি’র ডিসি তাহিয়াত চৌধুরী ওই সময় সুমন তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান চালিয়েছেন। সুমন ও সিন্ডিকেটরা অক্ষত থাকলেও পরবর্তীতে অবশ্য চিনি চোরাচালান রোধ করা সম্ভব হয়েছিল। দাশপাড়ায় একাধিক প্লট ও বাসার মালিক সে। তার মালিকানাধীন একটি জমিতে চিনি’র গোডাউন গড়ে  তুলেছিল। পটপরিবর্তন ৫ই আগস্ট ২০২৪। তখন জাফলং থেকে শাহপরান বাইপাস পর্যন্ত চিনি সীমান্ত চোরাকারবারিদের গডফাদার সুমন চৌধুরী। বিএনপি ও যুবদলের নেতাকর্মীরা প্রথমেই তাকে টার্গেট করেন। নিজেকে বাচাতে বিএনপি নেতাদের আশ্রয়ে চলে যায় সুমন। উপশহর ও  মেজরটিলাকেন্দ্রিক বিএনপি নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থেকেই সে চিনির পরিবর্তে ভারত থেকে জিরার ব্যবসা শুরু করে। বহালই থাকে সুমন। পুর্ব সিলেটের জিরা ব্যবসার নিয়ন্ত্রক ধরা হয় তাকে। শহরতলীর দাশপাড়াই এখন সুমনের আস্তানা। সেখানে বসে চার থানার চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করার ফলে তাকে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঘুম হারাম ছিল। নগর ও আশপাশে একাধিকবার অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। তার বিরুদ্ধে নগরের শাহপরান, এয়ারপোর্ট, জালালাবাদ থাকায় একাধিক মামলা রয়েছে। জকিগঞ্জ থানারও পরোয়ানাভুক্ত আসামি সে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সিলেট মেট্রো ডিবি’র সদস্যরা নগর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। রাতেই তাকে তুলে দেয়া হয়েছে জকিগঞ্জ পুলিশের হাতে। গ্রেপ্তারের পর তাকে নিয়ে চলে নাটকীয়তা। ছাড়িয়ে নিতে তদবির যায় থানায়। জকিগঞ্জ থানার সাব-ইন্সপেক্টর আব্দুল্লাহ আল মোমেন শুক্রবার বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- সুমন মেম্বারকে জকিগঞ্জ থানায় ছাত্রদল নেতা আবু জাফরের দায়ের করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানান তিনি।