জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চোরাগোপ্তা হামলা, গুপ্তহত্যা, আগুন-সন্ত্রাসের মতো আরও ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসবে, এ ধরনের তৎপরতা তত বাড়তে পারে। তারা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ির ঘটনাতেও সুযোগ নিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। এর অন্যতম উদাহরণ ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা। ওই ঘটনায় কাদা ছোড়াছুড়ির কারণে ওই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তবে এরই মধ্যে শরিফ ওসমান হাদিকে গুলির সন্দেহভাজন মূল শুটার ফয়সাল করিম মাহমুদের স্ত্রীকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মূল হোতাও আটকের কাছাকাছি রয়েছে।
রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে অনুষ্ঠিত জরুরি আইনশৃঙ্খলা বৈঠকে আলোচনায় এসব বিষয় উঠে আসে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আরও জানা গেছে, বৈঠকের আলোচনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতার বিষয়গুলোও উঠে আসে। উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই বলেছেন, জামিনে বেরিয়ে আসা সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া আচরণ করছে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মনিটরিংয়ে রেখে অপকর্ম করছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তাদের মনিটরিং করা কঠিন হচ্ছে। একজন নির্বাচন কমিশনার বৈঠকে জানান, নির্বাচন নিয়ে হুমকি আসছে। তফসিল ঘোষণার দিন (বৃহস্পতিবার) ইসির সিনিয়র সচিবকে মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে বড় ধরনের আক্রমণের কথা জানানো হয়েছে। এতে ফেব্রুয়ারিতে ভোট হবে না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
বৈঠকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে দ্রুত সটকে পড়তে না পারে, সেজন্য চেকপোষ্ট বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া, সহিংস ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধে পরামর্শ দেওয়া, সীমান্ত এলাকায় বিজিবির পাহারা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
এদিকে ইসির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শরিফ ওসমান হাদির শুটার ফয়সাল করিম মাহমুদ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশনের ঠিকাদার ছিল। তার প্রতিষ্ঠানের নাম অ্যাপল সফট আইটি। নির্ধারিত নিয়মে কাজ শেষ করতে না পারায় ২০২২ সালে ওই প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। তখন পিস্তল নিয়ে ইসিতে প্রবেশ করেছিল ফয়সাল করিম মাহমুদ।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে প্রকাশ্যে গুলি, লক্ষ্মীপুরে নির্বাচন কার্যালয়ে আগুন, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসে আগুন দেওয়ার চেষ্টার ঘটনায় পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির সিনিয়র সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসএম কামরুল হাসান, পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম, বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আব্দুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ ও ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী উপস্থিত ছিলেন।
ওই বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেছেন, নির্বাচন সময়মতো হবে এবং নির্বাচনের পথে এ ধরনের যে বাধাগুলো তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, এগুলো সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন অবহিত। সরকারও অবহিত। সরকার তথা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার যেসব কার্যক্রম এ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। তবে যেসব জায়গায় আরও অধিকতর কাজ করার অবকাশ আছে, সেগুলো নিয়েও কথা হয়েছে। তিনি বলেন, সার্বিক বিষয়ে আমরা অবগত আছি, অবহিত আছি, সতর্ক আছি। ইসির বার্তা পরিষ্কার; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। মাঠপর্যায়ে চোরাগোপ্তা হামলার যে ঘটনাগুলো ইতোমধ্যে ঘটেছে সেগুলোর স্বরূপ নিরূপণ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এগুলোকে প্রতিহত করার জন্য যথাযথ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নির্বাচন নিয়ে কোনো আশঙ্কা নেই জানিয়ে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, যারাই এই নির্বাচন বানচাল করার, প্রতিহত বা ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করবে, তারা ব্যর্থ হবে। এবং যেখানে যতটুকু দৃঢ় হওয়া প্রয়োজন, সব বাহিনী ততটুকু দৃঢ় হবে। নির্বাচন নিয়ে কোনো আশঙ্কা নেই।
বৈঠকে যেসব আলোচনা হয় : জানা গেছে, বৈঠকে নির্বাচন সামনে রেখে বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং শরিফ ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। একপর্যায়ে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের হুমকি আসছে। বক্তব্যের একপর্যায়ে তিনি বলেন, ইসির সিনিয়র সচিবকে মেসেজ দিয়ে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে ভোট হবে না। বড় ধরনের অ্যাটাক হবে। পোস্টাল ভোটের অ্যাপে ভারত ও ইসরাইল থেকে বারবার সাইবার অ্যাটাক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পথে পথে চেকপোস্ট থাকলে সন্ত্রাসীরা দ্রুত পালাতে পারে না। নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জরুরি মিটিং করে আগাম তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের আইডিইএ-২ প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ভোট সামনে রেখে অতির্কিত হামলা, গুপ্তহত্যা, আগুন-সন্ত্রাস, ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে আগুন, কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠানে হামলা-আগুনের মতো ঘটনা বাড়তে পারে। এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। আরেকটি বাহিনীর প্রধানও তার বক্তব্যে এ ধরনের হামলার আশঙ্কার কথা জানান।
বৈঠকের একপর্যায়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেওয়া পদক্ষেপ তুলে ধরেন। তিনি জানান, সন্দেহভাজন মূল শুটার ফয়সাল করিম মাহমুদের স্ত্রীকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মূল হোতা আটকের কাছাকাছি রয়েছে। এছাড়াও বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সন্দেহভাজন এক আসামির অভিভাবককে আটক করা হয়েছে।
বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করার পর রাজনৈতিক দলগুলোর কাদা ছোড়াছুড়ির কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ওই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এর সুযোগ নেয় শুটাররা। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলো অহেতুক কাদা ছোড়াছুড়ি না করে, সেজন্য ইসি থেকে তাদের অনুরোধ জানানো যেতে পারে। বিশেষ করে নতুন গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলে নতুন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড যাতে জেনে নেয়, সেই বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।
বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী বিজিবির সদস্যরা সীমান্ত পাহারায় একস্থানে গেলে, আরেক স্থান ফাঁকা হয়ে যায়। এর সুযোগ নেয় স্থানীয় দালালরা। সীমান্ত দিয়ে অবৈধ লোক চলাচলে বন্ধ ও স্থানীয় দালালদের ফাঁদে ফেলতে বিশেষ কৌশল নেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তা বিবেচনায় কক্সবাজার এলাকা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ওই জেলায় বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে।
ইসি আরও যা বলেছে : বৈঠকের শুরুতে শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সিইসি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ঘটনাটি তার মাথায় ‘বাজ পড়ার’ মতো। তিনি আরও বলেন, আমি আগেরদিন তফসিল ঘোষণা করলাম, আর পরের দিনই এমন একটি ঘটনা ঘটল। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।
ইসি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, মূলত সাম্প্রতিক সময়ে একটা ঘটনা সবাইকে উদ্বিগ্ন করেছে। সেটা শরিফ ওসমান হাদির ওপরে হামলা। চোরাগোপ্তা হামলা। এটা নিয়ে বিশাল আলোচনা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে আমরা আর বিস্তারিত বলছি না। সেখানকার অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয় সম্বন্ধে আমরা অবহিত হয়েছি। যেগুলোর সঙ্গে নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের স্বার্থ জড়িত।
তিনি বলেন, দুটো উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচন অফিসে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে। চোরাগোপ্তা হামলার সম্ভাবনা আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। সামনেও যে সম্ভাবনা নেই তাও বলছি না। বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য, এ ধরনের হামলার ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে বা এগুলো যাতে কঠোরহস্তে দমন করা হয়। এই কমিশনার জানান, গোয়েন্দা কার্যক্রমের অংশ হিসাবে সংশ্লিষ্ট সব বাহিনীর গোয়েন্দা তথ্য সমন্বয় করে কাজ করার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে দেশের বর্ডার অঞ্চলসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা এবং সেই বর্ডার এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে কিছু প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে, যেটার সঙ্গে বৃহত্তর কোনো ঘটনার সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।
নির্বাচনি তফসিলের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনা ঘটল, এটি নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে কিনা জানতে চাইলে ইসি সানাউল্লাহ বলেন, যারা এ কাজটা করতে চাচ্ছে, তারা একটা ভীতির পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে। সেটা প্রতিরোধ করার জন্যই আজকের এই মিটিং।
ইসি সানাউল্লাহ আরও বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর যে কোনো ঘটনার একটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব নির্বাচনের ওপর থাকবেই। থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। বরং স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নির্বাচনের ওপর প্রভাব ফেলবে। সুতরাং সেটাও আমাদের আমলে নিতে হচ্ছে।