Image description

গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রায় সব কাউন্সিলরই আত্মগোপনে রয়েছেন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দিলেও গতি ফেরেনি নাগরিক সেবায়। বারবার প্রশাসক পরিবর্তন আর ওয়ার্ডগুলোতে নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় জনগণ পাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। রাজধানীতে মশার উপদ্রব এখন ভয়াবহ পর্যায়ে।

ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের আতঙ্ক বাড়ছে।

এক বছরের বেশি সময়ের মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে কয়েক দফা প্রশাসক পরিবর্তন হয়েছে। কেউ সচিব হয়ে করপোরেশন ছেড়েছেন, কেউ বিরতি দিয়ে এক করপোরেশন ছেড়ে হয়েছেন অন্য করপোরেশনের প্রশাসক। বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান ছিলেন ডিএনসিসির প্রশাসক।

পরে গত ফেব্রুয়ারিতে সেখানে বর্তমান প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজকে এক বছরের জন্য নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। দীর্ঘ সময় উত্তরের দায়িত্বে থাকলেও সম্প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসক এজাজের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন উপায়ে দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যে জড়ানোর অভিযোগ কমিশনে জমা পড়ে। এসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা যাচাইয়ের পর আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে দক্ষিণের নতুন প্রশাসক পদে যোগ দিয়ে মাহমুদুল হাসান প্রায় এক মাস পার করলেও নাগরিক সেবায় কোনো গতি আসেনি। বরং সাবেক প্রশাসক শাহজাহান মিয়ার রেখে যাওয়া চলমান কাজের গতিও থমকে গেছে। মশক নিধন কার্যক্রম চলছে ঢিলেঢালাভাবে। ৩৫টি কমিউনিটি সেন্টারের মধ্যে চলমান ১৩টি। কিছু সংস্কারকাজ চালু হলেও এখন বন্ধ।

সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন মার্কেটের চলমান উন্নয়নকাজও প্রায় বন্ধ, নতুনগুলোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দুই সিটি করপোরেশনের ৯৫ শতাংশ কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছিলেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে তাঁরা আত্মগোপনে রয়েছেন। মেয়রদের অপসারণ করে কাউন্সিলরদের রেখে নগর প্রশাসন ও সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এই বাস্তবতা মানছেন বর্তমানে প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা প্রশাসকদের কেউ কেউ।

মশায় নাগরিকদের দুর্দশা চরমে : রাজধানীতে মশার উপদ্রব লাগামহীন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, মশা মারতে কামান দাগার মতো হাজার কোটি টাকা খরচেও রাজধানীবাসীর জন্য তা স্বস্তি এনে দিতে পারেনি। উল্টো মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মানুষের জীবন কচু পাতার পানির মতো টালমাটাল। মশা নগরবাসীর জীবন বিপন্ন করে তুলছে। অঢেল টাকা খরচ আর প্রচার-প্রচারণা সবই যেন জলে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, শুধু চলতি বছর গতকাল সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মহানগরীর হাসপাতালগুলোতে মোট ৩০ হাজার ৮৯৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে উত্তরে ১৬ হাজার ৬০৩ জন এবং  দক্ষিণে ১৪ হাজার ৩২০ জন। এ সময় উত্তরে ৬৮ জন এবং দক্ষিণে ১৯২ জন মারা গেছেন।

নগরবাসী বলছেন, মশার উপদ্রব এত বেড়েছে যে দিনের বেলায়ও ঘরের জানালা বন্ধ  রাখতে হয়।  অল্প সময়ের জন্য দরজা খুললেই মশার মিছিল ঢুকছে। রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় শিশু সন্তান আহনাফ জারিশকে নিয়ে থাকেন নুসরাত-জাহান দম্পতি। নসুরাত বলেন, এত দিন মশা কম থাকলেও এখন বেড়েছে। মশা বৃদ্ধি মানে বাচ্চাকে নিয়ে ভয়ে থাকা। ডেঙ্গুও এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তাই ভয়ে দিনের বেলায়ও রাতের মতো ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে হয়। বাসা থেকে বের হতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য দরজা খুললেই মশায় ঘর ভরে যায়। প্রাইভেট কম্পানির চাকুরে জয়নাল আবেদিন বলেন, বাসা আজিমপুর। কী আর বলব। এভাবেই কেটে যাচ্ছে। মশার জন্য কোথাও শান্তি মতো বসারও সুযোগ নেই। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সব সময় ভয়ে থাকি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময় মশার উপদ্রব বাড়বে এটা স্বাভাবিক। তবে এখন ডেঙ্গুর চেয়ে কিউলেক্স মশা বেশি হওয়ার কথা। সেটিই হচ্ছে। কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, এই সময় কিউলেক্স মশা বাড়বে। তবে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা কমে যাওয়ার কথা থাকলেও কমেনি। এটি জলবায়ু পরিবর্তন এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি মানুষকে সর্বোচ্চ সচেতন হতে হবে। কারণ, করপোরেশন অনেক জায়গায় যেতে পারে না, যেখানে এডিস মশার জন্ম হয়।

মশা নিধনে বাজেট বাড়লেও উপদ্রব কমে না : দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ বছরে ঢাকার মশা নিধনের নানা পদক্ষেপের পেছনে খরচ হয়েছে এক হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে দুই সিটিতে মশা নিধনে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫৪ কোটি টাকা। ডিএসসিসির ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে মশা নিধনে কীটনাশক কিনতে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় ধার্য রাখা হয়। উত্তরে বরাদ্দ রাখা হয় প্রায় ১১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মশা নিধনে কীটনাশক কিনতে বরাদ্দ রাখা হয় ৬৫ কোটি টাকা। বাকি অর্থ ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন ও পরিবহন, ব্লিচিং পাউডার ও জীবাণুনাশক এবং মশা নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কিনতে বরাদ্দ রাখা হয়।

২০২৫-২৬ অর্থবছরে দুই সিটির বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নতুন অর্থবছরে এক কোটি টাকা বাড়িয়ে মশা নিধনে ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ডিএসসিসি। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরে মশা নিধনে ফগার, হুইল ও স্প্রে মেশিন বাবদ আরো দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটিতে মশা নিয়ন্ত্রণ কাজের জন্য ১৮৭ কোটি টাকা, মোট বাজেটের ৩ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ আগের বছরে ছিল ১১০ কোটি টাকা।

মশা নিধনে দুই সিটির কার্যক্রম : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, প্রতিদিন সকাল-বিকেল প্রতিটি ওয়ার্ডে লার্ভিসাইডিং ও এডাল্টিসাইডিং করা হয়। এ বছর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর জনসচেতনতার কাজে জোর দেওয়া হয়েছে। করপোরেশনের প্রতিটি অঞ্চলে ছোট ছোট টিম করে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করা হচ্ছে। ওয়ার্ড সচিবদের সমন্বয়ে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা কাজ করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, আসলে যে যা-ই বলুক, শুধু কীটনাশক ছিটিয়ে মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যদি তাই হতো, নিয়মিত ক্রাশ প্রোগ্রাম, লার্ভিসাইড বা কীটনাশক প্রয়োগ করা হলেও কেন মশা কমছে না।

কর্তারা যা বলছেন : এসব বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান এনডিসি বলেন, মশা নিধনকে অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যক্রম চলছে। মার্কেট, কমিউনিটি সেন্টারসহ কিছু কাজ থমকে গেছে বিষয়টি ঠিকই। তবে আমরা এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজে গতি আনতে পারব। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, আমরা গতানুগতিক কাজের বাইরেও মশা নিধনে পদক্ষেপ নিচ্ছি। এখন কিউলেক্স মশা বেশি। ডেঙ্গু অনেক কমে গেছে।

নিজের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান বিষয়ে তিনি বলেন, দুদকের অনুসন্ধান আমার কাজে প্রভাব ফেলছে না। উনারা অনুসন্ধান করছেন, আমি সব ধরনের সহায়তা করছি। আশা করি কোনো সমস্যা হবে না।

নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে ঢাকা মহানগরীতে যে ভঙ্গুর দশা চলছে, এটির জন্য জনপ্রতিনিধি না থাকা অন্যতম কারণ হতে পারে। তবে এটি একমাত্র কারণ নয়। কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছারও অভাব রয়েছে। এমন অভ্যুত্থানের পর সাধারণ মানুষ যে গুণগত পরিবর্তন আশা করেছিল তা হয়নি।