Image description
ভারত থেকে ৮০ পেশাদার খুনি অনুপ্রবেশের অভিযোগ

জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশকে অস্থিতিশীল করতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা গত কয়েক মাসে অন্তত ৮০ জন পেশাদার খুনিকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করিয়েছে। এমন চাঞ্চল্যকর অভিযোগ করেছেন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের।

গত শুক্রবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ দাবি করেন। জুলকারনাইনের ভাষ্য অনুযায়ী, অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে রয়েছে সুব্রত বাইনের মতো কুখ্যাত আন্ডারওয়ার্ল্ড সন্ত্রাসী ও চরমপন্থী গ্রুপের সদস্যরা, যারা দেশের বিভিন্ন সীমান্ত ও প্রবেশপথ ব্যবহার করে দেশে ঢুকেছে। ফেসবুক পোস্টে জুলকারনাইন সায়ের লিখেছেন, আন্ডারওয়ার্ল্ড সন্ত্রাসী, কুষ্টিয়া-মেহেরপুর অঞ্চলের চরমপন্থী গ্রুপ এবং নিষিদ্ধ সংগঠনের কিছু সদস্য একত্রিত হয়ে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বড় ধরনের সহিংসতার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। তাদের লক্ষ্য হিসেবে বিভিন্ন প্রার্থী, কেন্দ্রীয় নেতা ও নিজ নিজ এলাকার জনপ্রিয় নেতাদের টার্গেট করে হত্যাকা- ও সহিংসতা ঘটানোর বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারনা এটি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার টার্গেট কিলিং মিশন।

জুলকারনাইন দাবি করেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, যিনি আগে সুব্রত বাইনের হ্যান্ডলার ছিলেন। তিনি জামিনে থাকা পিচ্চি হেলাল এবং চরমপন্থী সংগঠন গণমুক্তি ফৌজের প্রধান মুকুল সম্প্রতি টেলিফোন কনফারেন্সের মাধ্যমে এসব পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছে। জুলকারনাইনের পোস্টে আরও উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে কারাগারে থাকা সুব্রত বাইন তার মেয়ের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে কনফারেন্স কলের মাধ্যমে পিচ্চি হেলাল ও পশ্চিমবঙ্গে পলাতক মুকুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। পরে সুব্রত বাইনের মেয়ে সিনথিয়া বিতু নেপালে পলাতক বিডিআর মামলার আসামি লেদার লিটন, পিচ্চি হেলাল, মুকুল, বাড্ডার বড় সাঈদ ও দিপুর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয় বলে অভিযোগ করা হয়। জুলকারনাইন সায়ের সতর্ক করে বলেন, নির্বাচন বানচাল এবং দেশকে চরম অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে একটি বিশেষ গোষ্ঠী সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। এ ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনের মামলা ছিল। ওই মামলায় তার জামিনপ্রাপ্তির পুরো প্রক্রিয়া নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। মামলার নথি ও হাইকোর্টের আদেশ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও জামিনের সময়, মেয়াদ স্বাভাবিক বিচারিক প্রক্রিয়ার চেয়ে দ্রুত, যা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে। ধারনা করা হচ্ছে, এখানেও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর হাত রয়েছে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে অস্ত্র মামলার আসামী চিহ্নিত খুনি ফয়সাল করিম মাসুদকে জামিন দেয়া হয়েছে।

২০২৪ সালের ৮ নভেম্বর ডাকাতির সময় অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন ফয়সাল করিম মাসুদ। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকায় একটি অফিসে ঢুকে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনায় র‍্যাব তাকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করা হয় এবং একাধিক মূলধারার গণমাধ্যমে তার ছবি ও পরিচয় প্রকাশিত হয়। গ্রেফতারের পর ফয়সাল করিমের জামিনের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন অ্যাডভোকেট কায়সার কামাল ও অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান। চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মোহাম্মদ আলী ও বিচারপতি এসকে তাহসিন আলীর বেঞ্চ তাকে ছয় মাসের জামিন দেন। আদালতের নথি অনুযায়ী, ওই দিন আদেশ দেওয়ার পর আনুষাঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে ১৯ ফেব্রুয়ারি আদেশটি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। সাধারণত আদেশ প্রস্তুত ও আপলোডে সময় লাগলেও এই ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি তুলনামূলকভাবে দ্রুত সম্পন্ন হয়েছে বলে নথিতে দেখা যায়।

এরপর চলতি বছরের ১২ আগস্ট জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য পুনরায় আবেদন করা হলে বিচারপতি মোহাম্মদ আলী ও বিচারপতি ইউসুফ আব্দুল্লাহ সুমনের বেঞ্চ নতুন করে এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন। ফলে অস্ত্র আইনের মামলায় গ্রেফতারের পর এক দফা ছয় মাস এবং পরবর্তী দফায় এক বছরের জামিন পান ফয়সাল করিম মাসুদ। হাইকোর্টের এই দুটি আদেশের কপি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে। এই জামিন প্রক্রিয়া নিয়ে অনুসন্ধানী সংবাদ মাধ্যম দ্য ডিসেন্ট তথ্য প্রকাশ করে। গতকাল শনিবার দ্য ডিসেন্ট তাদের ফেসবুক পেজে ফয়সালের জামিনসংক্রান্ত দুটি ডকুমেন্ট যুক্ত করে দাবি করে, গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও জামিনের ধারাবাহিকতা ও সময়সীমা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দ্য ডিসেন্টের অনুসন্ধানে আরও বলা হয়, গুলিবর্ষণের ঘটনার সঙ্গে ফয়সাল করিম মাসুদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বিভিন্ন তথ্য ও চিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে মিলেছে। দ্য ডিসেন্টের দাবি অনুযায়ী, শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করা সন্দেহভাজন ব্যক্তি গত ৯ ডিসেম্বর ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং হাদির পাশেই বসে আলোচনাও শুনছিলেন। ওই প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য অনুযায়ী, ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের সিসিটিভি ফুটেজ, পুলিশের সংগৃহীত হামলার সিসিটিভি ফুটেজ, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি এবং ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে থাকা ফয়সাল করিম মাসুদ নামের অ্যাকাউন্টসহ আওয়ামীপন্থি বিভিন্ন পেজে থাকা ৫০টির বেশি ছবি তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করে তারা এই দাবি করেছে।

অনুসন্ধানে আরও উল্লেখ করা হয়, তিনটি আলাদা ঘটনায় সামনে আসা ব্যক্তির চেহারার সঙ্গে ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান নামের একজনের মিল পাওয়া গেছে। তিনি রাজধানীর আদাবর থানা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন বলে পুরোনো সংবাদে উল্লেখ রয়েছে। বিশেষভাবে নজর কেড়েছে গুলিবর্ষণকারী ব্যক্তির বাম হাতে থাকা একটি বিশেষ ডিজাইনের ঘড়ি। একই ডিজাইনের ঘড়ি পরা একাধিক ছবি ফয়সাল করিমের ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুক প্রোফাইলে পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছে দ্য ডিসেন্ট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনাগুলো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অনেকেই। শাকিল আহমেদ নামের এক ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন, যারা অপরাধীদের জামিন করিয়েছেন এবং যারা জামিন দিয়েছেন, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা উচিত। তার ভাষায়, টাকার কাছে বিচার ব্যবস্থা বিক্রি হয়ে গেলে অপরাধীরা নিশ্চিত থাকে, অপরাধ করেও তারা পার পেয়ে যাবে।

সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর পরই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর মদদপুষ্ঠ খুনিরা কিলিং মিশনে সক্রিয় অথবা একেক দিন একেক ঘটনার জন্ম দিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে তারা ইতোমধ্যে ছাত্রলীগের ক্যাডারদেরকে দিয়ে ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকাগুলোকে খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, নাশকতা বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র করছে। আমেরিকায় পলাতক আওয়ামী লীগের একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসীও এ কাজে সমন্বয় করছেন বলে সূত্র দাবি করছে। ওই সূত্রের মতে, পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থা এখন আগের মতো সক্রিয় নয়। এই সুযোগটাকে তারা কাজে লাগিয়ে নির্বাচনের আগে দেশকে অস্থিতিশীল করতে তৎপরতা চালাবে। এজন্য যা রসদ দরকার সবই অপ্রতৃল রয়েছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের নিস্ক্রিয়তাকে উল্লেখ করে সূত্র জানায়, এখনও দেড় হাজারেরও বেশি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। আর জুলাই বিপ্লবের সময় ছাত্রলীগ তথা আওয়ামী ক্যাডারদের হাতে যে সব অত্যাধুনিক অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছিল সেগুলো সুরক্ষিত আছে। এখন সেগুলোই ব্যবহার করা হচ্ছে বা হবে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া না হলে নির্বাচনকালীন সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে। এ অবস্থায় সীমান্ত নজরদারি জোরদার, গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্ট মহলের সমন্বিত উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছেন তারা।