বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত ক্রমেই এক গভীর আস্থার সংকটে পড়ছে। বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি, ব্যাপক বেসরকারি বিনিয়োগ এবং বাজার সম্প্রসারণ সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের জন্য মানসম্মত ও সাশ্রয়ী চিকিৎসাসেবা এখনো অধরা। ফলে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক রোগী উন্নত চিকিৎসার আশায় দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছেন, যার কারণে দেশ থেকে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা বেরিয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রতি বাৎসরিক ব্যয় ১০৭০ টাকা। তার পরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রায় ৪৯ শতাংশ জনগণ গুণগত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। যদিও বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতের বাজার সম্প্রসারিত হয়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে এবং ২০৩৩ সালে এ বাজার ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩১, ০২২ কোটি টাকা, যা আগের বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। তবে মোট বাজেটের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের হার এখনো মাত্র ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হওয়ায় রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা কাক্সিক্ষত সক্ষমতা অর্জন করতে পারছে না। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি ১ হাজার জনের বিপরীতে হাসপাতালের শয্যা মাত্র শূন্য দশমিক ৮৮টি, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড তিনটি। এ ছাড়াও প্রতি ৮৩০ জনে মাত্র একজন ডাক্তার, প্রতি ১১ হাজার ৫৩১ জনে একজন ডেন্টিস্ট, প্রতি ৫৬, ৫৯৯ জনে একজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট। বিশেষ করে নার্স ও টেকনোলজিস্টের সংকট ভয়াবহ। প্রতি ১০ হাজার জনের বিপরীতে নার্সের সংখ্যা ছয়জনেরও কম, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী ৭০ জন থাকার কথা। ঢাকাকেন্দ্রিক সেবাব্যবস্থা গড়ে ওঠায় স্বাস্থ্য খাতে বিরাজ করছে চরম বৈষম্য। দেশের মোট বিশেষায়িত হাসপাতালের ৫৩ শতাংশ ঢাকা বিভাগে অথচ দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করেন। ঢাকার বাইরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, উন্নত ডায়াগনস্টিক সুবিধা ও প্রশিক্ষিত নার্সের ঘাটতি মারাত্মক। ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার বাংলাদেশি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান, যা ভারতের মোট মেডিকেল ট্যুরিস্টের প্রায় ৫২ শতাংশ। রোগীদের মতে, বিদেশে যাওয়ার প্রধান কারণ চিকিৎসার অভাব নয়, বরং রোগ নির্ণয়ের ওপর আস্থার ঘাটতি। এ ছাড়া অপ্রত্যাশিত বিল ও গোপন খরচ, নিম্নমানের ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রীর আশঙ্কা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৩-৭৪ শতাংশই রোগীদের নিজ পকেট থেকে দিতে হয়। স্বাস্থ্যবিমার আওতায় রয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। ফলে একটি গুরুতর রোগ পরিবারকে দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আঞ্চলিক ও উন্নত দেশের তুলনায় স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। জাপানে আউট-অব-পকেট ব্যয় মাত্র ১১ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৩০ শতাংশ, তবে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশে তা ৭৪ শতাংশ, কার্যত অনিয়ন্ত্রিত। ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর মাত্র ৫২, যেখানে সিঙ্গাপুর ও জাপানের স্কোর ৮০। স্বাস্থ্যনীতিনির্ধাকদের মতে, আস্থা ফিরিয়ে আনতে জরুরি স্বাস্থ্য বাজেট ধাপে ধাপে জিডিপির ৫ শতাংশে উন্নীত করা, চিকিৎসাসেবার মান মূল্য নির্ধারণ ও বিলিং স্বচ্ছতা, স্বাধীন অ্যাক্রেডিটেশন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, কম খরচের স্বাস্থ্যবিমা চালু, ঢাকার বাইরে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটাল হেলথ সিস্টেম ও ইউনিক পেশেন্ট আইডি চালু, প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসকদের জন্য প্রণোদনা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি করা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল বাজার সম্প্রসারণ নয়, নৈতিকতা, জবাবদিহি ও আস্থাই হতে হবে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের মূল ভিত্তি। তা না হলে উন্নয়ন সত্ত্বেও দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা মানুষের আস্থা ফেরাতে ব্যর্থই থেকে যাবে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি এ কে আজাদ খান বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় বেশ অর্জন রয়েছে, তবে সামগ্রিকভাবে কাক্সিক্ষত মান নিশ্চিত করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি জানান, দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নতন দেশগুলোর মতো নয়, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে আমরা পিছিয়ে রয়েছি।