ঢাকার পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরে ঘটে যাওয়া বর্বর হত্যাকাণ্ডের জন্য ৫১ জনকে দায়ী করেছে স্বাধীন তদন্ত কমিশন। এদের মধ্যে আছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৬ রাজনৈতিক নেতা, সাবেক ১২ সামরিক কর্মকর্তা, ৪ ডিজিএফআই ও ২ এনএসআই কর্মকর্তা, ৪ র্যাব ও ৩ বিডিআর ও ৫ পুলিশ কর্মকর্তা, রয়েছে ৩ মিডিয়া কর্মী এবং তৎকালীন নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান। কমিশন প্রায় ১১ মাস তদন্ত শেষে রোববার প্রতিবেদন দাখিল করে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। প্রতিবেদনে পিলখানা ট্র্যাজেডিতে কার দায় কতটুকু তাও সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের কপি এখন যুগান্তরের হাতে।
পিলখানা ট্র্যাজেডিতে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহতের ঘটনা তদন্তে গঠিত স্বাধীন কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনাপ্রধান হিসাবে জেনারেল মইন ইউ আহমেদের দায়িত্ব ছিল বাহিনীর প্রতিটি অফিসার ও সৈনিককে নিরাপত্তা দেওয়া। তাকে যথাসময়ে জানানো হলেও তিনি অপারেশন পরিচালনার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না দিয়ে যমুনায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের অপেক্ষায় থাকেন। শুরুতেই মঈন ইউ আহমেদ সন্দেহাতীতভাবে জানতেন, সেনা অফিসারদের হত্যা করা হয়েছে। সময়ক্ষেপণ করলে আরও অফিসার হত্যা করা হবে। ওই পরিস্থিতিতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং রাজনৈতিক সমঝোতার নামে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলাকালে তৎকালীন বিডিআর সদস্যদের যে দল যমুনায় গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন সেই আলোচনায় উপস্থিত থাকলেও সেনাপ্রধান হিসাবে মইন ইউ আহমেদ কোনো ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেননি। বিডিআর প্রতিনিধিদলের অযৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সেনাবাহিনীকে বিডিআর সদস্যদের দৃষ্টিসীমার বাইরে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিলে তিনি বিনাবাক্যে ওই নির্দেশ পালন করেন। ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডকে প্রায় দুই মাইল পেছনে আবাহনী মাঠে অবস্থান করার নির্দেশ দেন। আর এতে ঘাতকরা অফিসারদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করার সুযোগ পান। সেনাসদস্যরা পিলখানার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার কারণে হত্যাকারীরা পিলখানা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ কাজে লাগায়। পিলখানার বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় অফিসারদের পরিবারের সদস্যদের ওপর নির্যাতন বেড়ে যায়।
হত্যাযজ্ঞের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে মইন ইউ আহমেদ যুক্ত ছিলেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি ছিলেন ওয়ান-ইলেভেনের রূপকার। ছিলেন ওয়ান-ইলেভেন অর্থাৎ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চালিকাশক্তি। ওই সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে তিনি বন্দি করেছিলেন। তাই তার ভয় ছিল, আওয়ামী লীগ সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। ওই ভয় থেকেই সরকারকে খুশি করতে তিনি ষড়যন্ত্রে অংশ নেন। সম্ভবত তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন, পরিস্থিতির ভয়াবহতার মধ্যে পুনরায় ক্ষমতা দখলের। বলা হয়, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অভিযান চালানোর প্রস্তুতির খবর জানার পরও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। এ বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত কমিশনকে তিনি জানান, ওই সময় পিলখানায় সেনা অভিযান চালালে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করত। তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করলে আর ভারতে ফেরত যেত না।
সত্য গোপন এবং দেশপ্রেমিক ও বিদ্রোহ দমনে উদ্যোগী সেনা কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতি, সাজা দেওয়া, পদোন্নতিবঞ্চিত করা, সেনাবাহিনীর মনোবলে আঘাত করা, হত্যা, লাশ গুম, নারী ও শিশু নির্যাতন, আলামত ধ্বংস, অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট, অপরাধীদের পলায়নে সহায়তা করাসহ বেশ কিছু অভিযোগে মইন ইউ আহমেদকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানকে সম্মত করার চেষ্টা না করার অভিযোগে সাবেক নৌবাহিনী প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল জহির উদ্দিন আহম্মেদ ও ওই সময়ের বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল এসএম জিয়াউর রহমানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বলা হয়, বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার আক্রান্ত হওয়ার পরও প্রতি-আক্রমণ করা হয়নি। আরও বলা হয়, সেনাপ্রধানের অনুপস্থিতিতে সামরিক অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব ছিল লে. জেনারেল সিনা ইবনে জামালীর। তিনি অভিযান চালানোর ব্যাপারে ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডকে সঠিক নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি সেনাপ্রধানকে সম্মত করার কোনো চেষ্টাও করেননি। জেনারেল আজিজ আহমেদকে দোষী সাব্যস্ত করার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, তিনি সামরিক শৃঙ্খলাভঙ্গ করে ঘটনাস্থলে আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে যান। বিডিআরে থাকাকালীন স্ত্রীর মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য করেন। নিয়মভঙ্গ করে ব্যারিস্টার তাপস হত্যাচেষ্টা ঘটনায় ফাঁসানো অফিসারদের ডিজিএফআইয়ের কাছে হস্তান্তর করেন। হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার অপচেষ্টা চালান। তদন্তে জেনারেল মইনুল ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে আছে-তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালে বিডিআর সদস্যদের অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রতিরোধে ব্যর্থতা, তাপস হত্যাচেষ্টা ঘটনায় ফাঁসানো অফিসারদের ডিজিএফআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া, সামরিক অফিসারদের অধিকার লঙ্ঘন, কোর্ট মার্শালের সময় সংযুক্ত অফিসারদের আইনি সহায়তা না দেওয়া, ডিজিএফআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া অফিসারদের পরিবারকে তথ্য ও অন্যান্য সহায়তা না দেওয়া।
লে. জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর বিষয়ে বলা হয়েছে, তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে বিদ্রোহের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। সামরিক শৃঙ্খলাভঙ্গের পাশপাশি তিনি মিথ্যা সাক্ষ্য দেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল হাকিম আজিজের বিষয়ে বলা হয়েছে, তিনি অপারেশনাল অর্ডার অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হয়েও প্রতি-আক্রমণ করেননি। সামরিক চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করেছেন। হত্যা এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের বিষয় নিশ্চিত হওয়ার পরও সামরিক অভিযান পরিচালনা না করে সম্পূর্ণ ব্রিগেডকে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেন। সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সাবেক সেনাপ্রধানকে সম্মত করার কোনো চেষ্টা তিনি করেননি। তদন্তে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামসুল আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এগুলো হলো-ষড়যন্ত্রে অংশ নেওয়া, ঘাতকদের হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া এবং দেশ ও জাতির কাছে সত্যও লুকানো।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমামুল হুদার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এগুলো হলো হত্যাচেষ্টা ঘটনায় অফিসারদের ফাঁসানো, আলামত যাচাই না করে অসত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা, কমিশনে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, নির্যাতনের মাধ্যমে সাদা কাগজে আসামিদের স্বাক্ষর গ্রহণের পর সেখানে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিখে তদন্ত প্রতিবেদন সম্পন্ন করা, ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং বাদী সাক্ষ্য গ্রহণ না করা। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, তদন্ত আদালতের সদস্য হিসাবে আলামত যাচাই না করে অসত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। এছাড়া প্রমাণের জন্য কোর্ট মার্শালে নতুন করে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন না করে তদন্ত আদালতের উদ্ঘাটিত তথ্যকে চূড়ান্ত হিসাবে বিবেচনা করে বিচারিক কাজ শেষ করেছেন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুব সারোয়ারকে দোষী হিসাবে প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যারিস্টার তাপস হত্যাচেষ্টার ঘটনায় সেনা অফিসারদের ফাঁসানোর ক্ষেত্রে তার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আলামত যাচাই না করে অসত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। এছাড়া সামারি অব এভিডেন্স রেকর্ডিং অফিসার হিসাবে নতুন করে সাক্ষ্যপ্রমাণ যাচাই না করে শুধু তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর সামারি অব এভিডেন্স প্রস্তুত করেছেন।