অবৈধ পথে দেশে মোবাইল ফোনের অবাধ প্রবেশ রোধ, রাজস্ব আদায় ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আগামী ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ‘ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্টার’ (এনইআইআর) চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া আর কোনো মোবাইল ফোন চালু হবে না। তবে সরকারের এই প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীরা। রাজপথে আন্দোলন করছেন তারা। ব্যবসায়ীদের দাবি- এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দেশের মোবাইল বাজার চলে যাবে সিন্ডিকেটের হাতে। মোবাইল ফোনের দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। একইসঙ্গে পথে বসতে হবে- ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ২০ হাজার ব্যবসায়ীকে।
বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের মোবাইল ব্যবসায়ী সেলিম আহমেদ বলেন, ২৫ বছর ধরে আমি এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু হঠাৎ করেই বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ৯টি সিন্ডিকেট দিয়ে পুরো মোবাইল বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা অবশ্যই সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে না, তাদের সিদ্ধান্তকে আমরা সম্মান জানাই। কিন্তু ২০ লাখ পরিবার যারা সরাসরি এ খাতের সঙ্গে যুক্ত। তাদের পথে বসিয়ে দিলে আমরা কোথায় যাবো? আমরা যথানিয়মে সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা করতে চাই। কিন্তু এখন সেই ভ্যাট যদি ৫৭ শতাংশ করা হয় তাহলে আমরা ব্যবসা করবো কীভাবে? জসিমউদ্দিন নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, এই এনইআইআর সিস্টেম ১৬ই ডিসেম্বর চালু হলে ২০ হাজার ব্যবসায়ী পথে বসবে। ১৮ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২ লাখ প্রবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, আমাদের জন্য ৫৭ শতাংশ ভ্যাট আর মুষ্টি কয়েক মানুষের ৭ দশমিক ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ। এই বৈষম্যটা কেন? তিনি বলেন, এখন একটি আইফোন মানুষ ১ লাখ টাকায় কিনতে পারছে। কিন্তু এনইআইআর চালু হলে তা কিনতে হবে ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা দিয়ে। এখানে ভোক্তাদেরই পকেট কাটা যাবে। তিনি বলেন, যখন কোনো কোম্পানি তাদের নতুন ফোন লঞ্চ করে তখন সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু সেই ফোন আমাদের দেশের বাজারে অফিসিয়ালি আসে না। অনেক পরে আসে। সেই ফোন কিন্তু আমরাই কম দামে লাগেজ পার্টির মাধ্যমে দেশের বাজারে নিয়ে আসি। আমরাই দেশের বাজারের সঙ্গে মানুষের চাহিদার ভারসাম্যটা রক্ষা করি।
কিন্তু এই প্রকল্প চালু হলে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কয়েকটি কোম্পানির ফোনই পাওয়া যাবে দেশে। তারা যেই মডেল বাজারে আনবে, যেই দাম নির্ধারণ করে দিবে সেটাই আমাদের বাধ্য হয়ে কিনতে হবে। মো. মিরাজ হোসেন নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, স্যামসাং, ভিভো, অপ্পো, আইটেল, টেকনো, ইনফিনিক্সসহ এমন অনেকগুলা কোম্পানি আছে। এই কোম্পানিগুলো তাদের কনফিগারেশন দেখাচ্ছে ১২/২৫৬। কিন্তু আপনি রিয়েল চেক করে দেখবেন ৬/১২৮, ৮/১২৮। আবার এখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- ১০টা আইএমইআই নম্বরের বদলে ১০ লাখ অবৈধ মোবাইল ফোন চলছে দেশে। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, এসব ব্যবস্থা ওই ৯টি কোম্পানির মোবাইলের ফোন কোম্পানির মধ্যেই আছে, আমাদের মধ্যে এসব নেই। আমরা যারা মোবাইল কিনে আনি আমরা অ্যাপেল, স্যামসাং ফ্লাগশিপ মোবাইল। একেবারে মাদার কোম্পানি থেকে আমরা এগুলো লাগেজ-ব্যাগেজের মাধ্যমে কিনে আনি। যেগুলোর আইএমইআই একদম রিয়েল। আবার কিছু প্রবাসী পরিবারের জন্য দুই-একটা মোবাইল নিয়ে এসে আমাদের বিক্রি করতে দেয় সেগুলোতেও কাস্টম ক্লিয়ার দেয়া থাকে। কিন্তু সেই প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদেরকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাই আমাদের প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশ্যে বলতে চাই- আপনার কাছে অনুরোধ- আপনি এই বিটিআরসি, এনবিআর কর্মকর্তাদের ডেকে আমাদের সঙ্গে বসানোর ব্যবস্থা করুন। আমরা এর শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।
এদিকে সরকারের এই এনইআইআর প্রকল্প চালু করার বিরোধিতা করে রোববার রাজধানীর কাওরানবাজার এলাকায় ‘স্মার্টফোন ও গ্যাজেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন মোবাইল বিজনেস কমিউনিটি বাংলাদেশ (এমবিসিবি)’ এর ব্যানারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে বসুন্ধরা সিটি শপিংমল, যমুনা ফিউচার পার্ক, মেট্রো শপিংমলসহ ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটের মোবাইল ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে রোববার সারা দেশের মোবাইল ফোনের দোকান বন্ধ রাখা হয়।
বিষয়টি নিয়ে মোবাইল বিজনেস কমিউনিটি বাংলাদেশের সভাপতি মো. আসলাম বলেন, সরকারের কাছে অনুরোধ করবো, আপনারা এই এনইআইআর সিস্টেম চালু করবেন না। আমরা চাই এনবিআর, বিটিআরসি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং আমরা ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে বসি। এই সমস্যার একটা সুষ্ঠু সমাধান হোক। আর যদি এটা না হয়, যদি আমাদের রাস্তায় নামতে হয় তাহলে আমরা ব্যবসায়ীরা এনবিআর, বিটিআরসি ওনাদের বাসায় গিয়ে আমাদের পরিবার নিয়ে হাজির হবো। তিনি বলেন, আমাদের মূল দাবি হচ্ছে- ইমপোর্ট প্রক্রিয়াটি সরকার আরও সহজ করে দিক। একটি কোম্পানি যদি ইমপোর্ট করে তাদের সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ ভ্যাট লাগে, আমাদের লাগে ৫৭ শতাংশ। এটা সহজ করা হোক। আমরা ব্যবসায়ীরা ট্যাক্স দিয়ে বৈধভাবে ব্যবসা করতে চাই।
এমবিসিবি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি শামীম মোল্লা বলেন, বিটিআরসি আগামী ১৬ই ডিসেম্বর থেকে যে এনইআইআর সিস্টেম চালু করতে যাচ্ছে, তা মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণে একটি নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটকে সুবিধা দিতেই আনা হয়েছে। কারণ ডাক ও টেলিযোগাযোগের দায়িত্বে যিনি আছেন তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুই ৩টি মোবাইল কোম্পানির মালিক। তাদের সুবিধা দিতেই পুরো দেশকে জিম্মি করা হচ্ছে।
তবে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন এর স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আমিনুল হক বলেন, এনইআইআর চালু করা মানে অবৈধ মোবাইল ফোন আমাদের নেটওয়ার্কে আসতে না দেয়া। ক্লোনিং বা চুরি হয়ে যাওয়া কোনো মোবাইল ফোন যেন আমাদের নেটওয়ার্কে আসতে না পারে এবং নাগরিক হিসাবে আমার ফোন যদি কখনো চুরি হয়ে যায় তখন আমার পর্যাপ্ত ডকুমেন্টসের মাধ্যমে আমি যেন ফোনটাকে ব্লক করতে পারি- একইভাবে আমার হাতে চলে আসার পর আমি যেন আনব্লকিং করতে পারি। যারা বিটিআরসি’র থেকে নিবন্ধিত তাদের স্বার্থটাও যেন রক্ষিত হয়। সরকারের রাজস্ব ক্ষতি রোধ করা। মোবাইল ফোনের বৈধতা যাচাই করা, অর্থাৎ আপনার হাতের মোবাইল ফোনটা বৈধ পথে দেশে এসেছে কিনা, ক্লোন কিনা, চোরাই কিনা- তা যাচাই করতে পারা। সবচেয়ে বড় জিনিস যেটা বর্তমানে আমাদের কাছে নেই- সেটা হলো- ‘ইনফর্ম ডিসিশন মেকিং’ এবং আমরা যদি কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নিতে চাই তাহলে আমাদের ডাটা ড্রাইভেন হওয়া উচিত। এই ডাটা এনালাইসিস করতে কি ধরনের হ্যান্ডসেট আমাদের দেশে পারফর্ম করছে, কোনটার প্রাধান্য বেশি এগুলো যদি আমরা জানতে চাই, তাহলে আমাদের এই ‘এনইআইআর’ এর ডাটাবেজটা লাগবে। আমরা যদি গ্রাহক পরিষেবার কথা চিন্তা করি এবং এটার বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে চাই তা হলেও আমাদের এই ধরনের ডাটাবেজ প্রয়োজন। এনইআইআর কীভাবে কাজ করবে সে সম্পর্কে তিনি বলেন, যেকোনো হ্যান্ডসেট আপনি যখন অন করবেন তখন এটার সিমের ওপর নির্ভর করে বিটিএস’র সঙ্গে কানেক্ট করার চেষ্টা করবে। আমরা প্রত্যেকটা এমএনইউরেন্টে একটি করে ইআইআর’র ব্যবস্থা করেছি। সেই ইআইআর-এ প্রত্যেকটা ডিভাইস চেক করবে সেটা রেজিস্টার্ড কিনা। যদি সে রেজিস্টার্ড থাকে তাহলে তার রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করবে। কোনো ফোন যদি আগেই রেজিস্ট্রি হয়ে থাকে তাহলে তাকে আর এনইআইআর’র কাছে আসতে হবে না। মোবাইল অপারেটরের পক্ষ থেকে ইআইআর-এ তথ্য দিয়ে দিতে পারবে। আর রেজিস্টার্ড না থাকলে তখন আইএমইআই নম্বর, ইউজি নম্বর ও এমএসআইএসডি’র নম্বর ইআইআর-এ পুশ করবে। তখন তার যেই মোবাইলে সিম আছে সেই নম্বরের বিপরীতে আমাদের সার্ভারে একটি সিভিভিপিএন নম্বর আছে সেখানে এই ফোনটার কি কি ডকুমেন্টস প্রয়োজন সেগুলো তাকে ফেইস করতে হবে। এতে করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কমিশনার (স্পেকট্রাম বিভাগ) মাহমুদ হোসেন বলেন, আমি মনে করি একটা কোয়ালিটি অফ নেটওয়ার্ক প্রয়োজন। কারণ আমাদের দেশে বিভিন্নভাবে চোরাই ফোন আসছে। যা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাই সরকার এই এনইআইআর প্রকল্পটি চালু করতে যাচ্ছে। তার মাধ্যমে আমাদের দেশের সকল তথ্য নিবন্ধিত থাকবে। যা আমাদের নিরাপত্তা দেবে। তিনি বলেন, আগামী ১৬ই ডিসেম্বর এনইআইআর চালু হলেই কিন্তু সব ফোন বন্ধ হবে, বিষয়টি কিন্তু এমন না। বৈধ-অবৈধ যেসব ফোন আমাদের দেশে চালু আছে তাদের সিমের রেজিস্ট্রেশনের নামে ফোনগুলো অটোমেটিক রেজিস্ট্রেশন হয়ে যাবে। যেগুলোর রেজিস্ট্রেশন থাকবে না এবং একই সঙ্গে চালু না সেগুলোই সচল করা যাবে না। সচল করতে হলে তাকে উপযুক্ত কাগজ-পত্র দিয়ে সচল করতে হবে।
অপরদিকে গত ১লা ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত) ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের সচিবালয়ের অফিস কক্ষে এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং বিটিআরসি’র এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে- প্রবাসীরা দেশে ছুটি কাটানোর সময়ে ৬০ দিন পর্যন্ত স্মার্টফোন রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই ব্যবহার করতে পারবেন। ৬০ দিনের বেশি থাকলেই মোবাইল ফোন রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। প্রবাসীদের যাদের বিএমইটি রেজিস্ট্রেশন কার্ড আছে, তারা ফ্রিতে মোট ৩টি ফোন সঙ্গে আনতে পারবেন। অর্থাৎ নিজের ব্যবহারের হ্যান্ডসেটের অতিরিক্ত দু’টি নতুন ফোন সঙ্গে নিয়ে আসতে পারবেন। চতুর্থ ফোনের ক্ষেত্রে ট্যাক্স দিতে হবে। আর যাদের বিএমইটি কার্ড নেই তারা নিজের ব্যবহারের ফোনের পাশাপাশি অতিরিক্ত একটি ফোন ফ্রিতে আনতে পারবেন। এক্ষেত্রে মোবাইল ক্রয়ের বৈধ কাগজটি নিজের সঙ্গে রাখতে হবে।