কোনো ঘোষণা ছাড়াই আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানোয় বাজারে অস্থিরা সৃষ্টি হয়েছে। বোতলজাত লিটারে ৯ টাকা ও খোলা তেলে ৫ টাকা পর্যন্ত বাড়তি মূল্য নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। উপদেষ্টা বলেন, তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে সরকার কিছুই জানতো না। সামগ্রিক একত্রিতভাবে করা এই কাজটি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এর আগে গত অক্টোবর মাসেও কোম্পানিগুলো সরকারের অনুমতি ছাড়াই ভোজ্য তেলের দাম বাড়িয়েছিল। তখন বাণিজ্য উপদেষ্টা কঠোর অবস্থান নেয়ায় শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
এদিকে হঠাৎ এই মূল্যবৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন ক্রেতারা। ভোক্তা অধিকারের সংগঠনগুলো বলছে, আগাম জানানোর নিয়ম না মেনে এভাবে দাম বাড়ানো ভোক্তাদের প্রতি চরম অবিচার।
কোম্পানিগুলোর দাবি, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে। তাই সরকারকে অবহিত করেই দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ব্যবসায়ীরা আবেদন করেছেন। কিন্তু দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেয়া হয়নি।
ওদিকে বিশ্ববাজারে পাম অয়েলের দাম রেকর্ড কমে এলেও সরকারের দেরিতে দাম সমন্বয়ের কারণে দেশের ভোক্তারা এর সুফল পাচ্ছেন না।
বাড়তি দামে বিক্রি: রাজধানীর কাওরান বাজারসহ কয়েকটি বাজারে দেখা গেছে, রূপচাঁদা, তীর, পুষ্টি, ফ্রেশসহ প্রায় সব ব্র্যান্ডের বোতলজাত সয়াবিন তেল বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। নতুন করে বাজারে আসা পাঁচ লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৯৬৫ টাকায়। এ ছাড়া বোতলজাত প্রতি লিটার ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বোতলজাত প্রতি লিটার এতদিন ১৮৯ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল। তবে এক ও দুই লিটারের নতুন দরের বোতল এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করা হয়নি। যদিও মঙ্গলবারের ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটিতে লিটারে ১৭৯ টাকা দামে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টিসিবি’র জন্য ৫০ লাখ লিটার সয়াবিন তেল কিনেছে।
কাওরান বাজারের মুদি ব্যবসায়ী আব্দুর রব স্টোরের স্বত্বাধিকারী নাঈম বলেন, এক সপ্তাহ আগে কোম্পানিগুলো জানিয়েছিল, বাজারে নতুন দরের তেল আসবে। দুইদিন ধরে তারা বাড়তি দামের তেল দিচ্ছে।
কয়েকজন ভোক্তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, বর্তমানে গ্রাহকরা যে দামে ভোজ্য তেল কিনছেন, সেটিই বিশ্ববাজারের তুলনায় অনেক বেশি। নাহিদ নামে একজন ভোক্তা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম কিছুটা কমে তখন দেশীয় বাজারে তার প্রভাব পড়ে না। বরং ব্যবসায়ীরা নানা যুক্তিতে বারবার দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের কষ্ট বাড়াচ্ছেন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, দাম সমন্বয়ের নামে ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের অসহায় পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন। এর আগে গত ১২ই আগস্ট পাম তেলের দাম ১৯ টাকা কমিয়ে লিটারপ্রতি ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। তবে সয়াবিন তেলের দাম তখন অপরিবর্তিত থেকে ১৮৯ টাকা ছিল। এরও আগে এপ্রিল মাসে সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৮৯ টাকা ও পাম তেল ১৬৯ টাকা।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, খুচরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি লিটার ১৮৯-১৯৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দাম বাড়ানো যৌক্তিক নয়: ব্যবসায়ীরা তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্মতি নেয়নি বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেন, মঙ্গলবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটিতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) জন্য দেড় কোটি লিটার ভোজ্য তেল কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ লাখ লিটার সয়াবিন তেল ও এক কোটি লিটার রাইস ব্রান তেল কেনা হবে। তিনি বলেন, সরকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে দামে ভোজ্য তেল কিনেছে, এখন বাজারে তার চেয়ে ২০ টাকা বেশি দামে তেল বিক্রি হচ্ছে। তিনি এর যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে আইনগত যা ব্যবস্থা আছে তা নেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর আগেও তারা দাম বাড়িয়েছিল। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এতে একমত পোষণ না করায় দাম বাড়েনি। উপদেষ্টা আরও বলেন, যদি দাম বাড়ানোর যৌক্তিক কারণ থাকে সেটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সরবরাহ বিঘ্নিত করতে চায় না সরকার। অযৌক্তিক কিছু মানবে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। রোজা সামনে রেখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভালো প্রস্তুতি আছে। আমদানির জন্য গতবারের চেয়েও এবার বেশি ঋণপত্র খোলা হয়েছে।
আদেশে যা আছে: ২০১১ সালের ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ’- অনুযায়ী, ব্যবসায়ী সমিতির মাধ্যমে মূল্যসমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া গেলেও ১৫ দিন আগে সরকারকে-বিশেষ করে মনিটরিং সেল, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে-লিখিতভাবে জানাতে হবে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর দাবি, তারা এই নিয়মই মেনে চলছে।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন বলছে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা সরকারকে অবহিত করে নতুন দর কার্যকর করেছে। তাদের দাবি অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে ১ হাজার ২০০ ডলার কাছাকাছি। সুতরাং দাম সমন্বয় করা প্রয়োজন। নতুন করে লিটারপ্রতি বোতলজাত তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯৯ টাকা এবং পাঁচ লিটারের বোতল ৯৮৫ টাকা। খোলা সয়াবিন লিটারপ্রতি ১৭৯ টাকা আর পাম অয়েল ১৬৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এসোসিয়েশনের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম মোল্লা বলেন, সরকারকে জানিয়েই তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে।
পদক্ষেপ নেয়ার অপেক্ষায় ক্যাব: এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবিত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের খসড়া নিয়ে বৈঠক হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন- কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি সাবেক সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন- সফিকুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এ আইন অনুযায়ী কিছু পণ্যের মূল্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে দেয়। মূল্য নির্ধারণ কীভাবে করা হবে, সেটার একটা সূত্র আছে। হঠাৎ করে ভোজ্য তেলের দাম লিটারে ৯ টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ভোজ্য তেল পরিশোধন কারখানার সমিতি যদি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ না করে তেলের দাম বাড়ায়, আমি বলবো, তা আইনের ব্যত্যয়।’ তিনি বলেন, বাণিজ্য উপদেষ্টা যে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন, আমরা তা দেখার অপেক্ষায় আছি।’ পরিশোধন কারখানা বন্ধ করে দেয়ার মতো বিধানও আইনে আছে জানিয়ে ক্যাব সভাপতি বলেন, ‘প্রতিযোগিতা আইন আছে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে। যদি কেউ মজুত করে দাম বাড়ায়, সেখানে বিশেষ আইন প্রয়োগের ব্যবস্থাও আছে। আমরা সেই আইনের প্রয়োগ দেখতে চাই।’ ক্যাবের সভাপতি বলেন, ইদানীং তদারকি বিষয়টা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। রাজনীতি ও আইনশৃঙ্খলার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যও কিন্তু বড় বিষয়। ভোক্তাদের স্বার্থে বাজার তদারকি জোরদার করা উচিত।
বিশ্বব্যাপী দাম কমেছে: বিশ্ববাজারে পাম অয়েলের দাম রেকর্ড কমে এলেও সরকারের দেরিতে দাম সমন্বয়ের কারণে দেশের ভোক্তারা এখনো এর সুফল পাচ্ছেন না। গত এক মাসে পাইকারি বাজারে এর দাম মণপ্রতি ৪৫০ টাকার বেশি কমলেও, খুচরা দাম প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। গত ১২ই আগস্ট সরকার ঢালা পাম অয়েলের খুচরা দাম লিটারপ্রতি ১৬৯ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে। সে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত পাম অয়েলের (সিপিও) বুকিং মূল্য ছিল টনপ্রতি ১,০২৬ থেকে ১,০৪৫ ডলারের মধ্যে, যা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু নভেম্বর নাগাদ এই বুকিং মূল্য টনপ্রতি ৯৫০-৯৮০ ডলারে নেমে আসে। অক্টোবরে গড় বুকিং মূল্যের তুলনায় ২৮শে নভেম্বর দাম ৭৫ ডলার কম ছিল। ৮ই অক্টোবর থেকে ১২ই নভেম্বরের মধ্যে কয়েক দফা কমায় দাম টনপ্রতি ৯৫৩ ডলারের নিচে নেমে যায়, যা সামপ্রতিক বছরে অন্যতম সর্বনিম্ন। আন্তর্জাতিক বাজারের এই বড় ব্যবধান এবং সরকারের সর্বশেষ খুচরা দাম নির্ধারণের সময়ের বাজারদরের মধ্যে অমিলের কারণেই পাইকারি দাম কমলেও এর প্রভাব ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. গোলাম মাওলা বলেন, ভোজ্য তেলের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া কার্যত অকার্যকর হয়ে গেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি মাসে দাম পর্যালোচনা করার কথা। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও আমদানিকারকরা কমাতে চান না, তবে দাম বাড়লে তারা বাড়ানোর চাপ দেন।