আগুনে পুড়েছে ঘর, সঙ্গে সঞ্চয়ও। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে থাকতে হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে। সহায়তা আসে কখনো ব্যক্তি উদ্যোগে, কখনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে, কখনো আবার কোনো সংস্থার নামীয় ব্যানার টাঙানো গাড়িতে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা নগণ্য। রাত নামলেই শীতের বাতাস নিঃশ্বাস চেপে ধরে; দিনের আলো ফুটতেই ভাঙা পোড়া টিন, গলে যাওয়া প্লাস্টিক আর পোড়া কাঠের গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে চারদিক। এভাবেই অনিশ্চয়তা আর বেদনাকে সঙ্গী করে চতুর্থ দিনেও ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধ চালাতে দেখা যায় বনানীর কড়াইল বস্তির হাজারো মানুষকে।
সরেজমিন দেখা গেছে, কড়াইল বস্তির চারপাশ একেবারেই ফাঁকা। বস্তিটি এখন শুধু পোড়া ইট, কালো ধোঁয়া আর চাপা কান্নার জমিন। শিশুদের বোবা আর্তনাদ, বয়স্কদের নিঃশ্বাস ফাটানো দীর্ঘশ্বাস- সবই যেন একই সুরে ভেসে বেড়ায়। কোথাও কোথাও এক ইঞ্চির ইট দিয়ে ঘেরা ঘরের সীমানা। ছাদহীন ঘরের চারপাশে কাপড় টাঙ্গানো। এর ভেতরেই রাত ও দিন কাটাচ্ছে বস্তিবাসী।
কড়াইল বৌ-বাজার বস্তির আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরের জায়গায় এখন চলছে হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙার শব্দ। যুবকরা কাঠের খুঁটি পরিষ্কার করছেন। নারীরা পোড়া জঞ্জাল তুলে আলাদা করছেন। শিশুরা খুঁজছে তাদের একমাত্র খেলনা বা স্কুলব্যাগের ছাই। সবাই জানে- এই পথ খুব কঠিন। তবুও দাঁড়াতে চাইছেন আবার নতুন করে।
বস্তির বাসিন্দা রহিমা বেগম ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, আমাদের জীবন এমনই- গড়ে তুলি, আবার পুড়ে যায়। কতবার যে ঘর বানালাম আর হারালাম- গুনে শেষ করতে পারি না।
শুক্রবার দুপুরে ক্ষতিগ্রস্ত আকলিমা বেগম বলেন, এখনো কিছু খাইনি। একটা বিস্কুট খেয়ে শুধু ওষুধ খেয়েছি। ঘরের সবকিছু পুড়ে গেছে। উদ্ধার করতে এসে অনেকে উলটো লুটপাটও করেছে। ত্রাণ আসছে কিন্তু সঠিকভাবে বিতরণে বড় সংকট। হাজারো পরিবারের বিপরীতে যা আসছে, তা একমুঠোই বলা চলে। সুমী বেগম নামের আরেক ক্ষতিগ্রস্ত নারী জানান, একদিকে শীত বাড়ছে, অন্যদিকে খাবার-পানির সংকটে চরম দুর্ভোগে দিন কাটছে তাদের।
মনোহারি দোকানি আব্দুস সালামের দুই বছরের শ্রম ও স্বপ্ন পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে। তিনি বলেন, জানিনা কোথা থেকে আবার শুরু করব, কিভাবে চলবে আমার পাঁচ সদস্যের পরিবার।
সেলাই মেশিন হারানো রাবেয়া খাতুনের চোখেও একই রকম অন্ধকার। তিনি বলেন, এটিই ছিল আমার রোজগারের একমাত্র হাতিয়ার। রাস্তায় খাবারের ভ্রাম্যমাণ স্টল চালানো আব্দুল গফুর আগুনে সব হারিয়ে অনেকটা নির্বাক। তিনি বলেন, আবার দোকানটা শুরু করতে গেলে অনেক টাকার দরকার। কিন্তু আমার তো আর কিছুই নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কড়াইলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা হতাশ, তবু ভেঙে পড়েননি। প্রান্তিক এসব মানুষ বারবার আগুনে পুড়ে আবার জেগে ওঠেন। তাদের জীবনের অভিধানেই যেন লেখা- পুড়ে গেলে কাঁদো, কিন্তু থেমে যেও না। আবার ঘর বানাও, আবার জীবন গড়ো।
ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, অনেকে ১-২ দিনেও কোনো সংস্থার খাবার পাননি। আবার অনেকেই পেয়েছেন- কিন্তু পরিমাণে তা নগণ্য। এদিকে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নষ্ট হওয়ায় তৈরি হয়েছে পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি। এবারের আগুনে ঘর হারানো মানুষের সংখ্যা এত বেশি যে, ব্যক্তি উদ্যোগ বা সংগঠনের আনা সহায়তা সঠিকভাবে বণ্টন করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সালাহ উদ্দীন ওয়াদুদ শুক্রবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে জানান, তারা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ১৯০০ পরিবারের তালিকা তৈরি করেছেন। প্রত্যেক পরিবারের মাঝে চাল, ডাল, তেল, হলুদসহ প্রায় ১৪ কেজি পণ্যের একটি করে প্যাকেট, দুই লিটার পানি, একটি মশারি ও কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, যে শুকনো খাবারগুলো দেওয়া হয়েছে, তাতে একেকটি পরিবারের এক সপ্তাহের মতো চলে যাবে। এদিকে ইউনিসেফও বস্তিবাসী শিশুদের শারীরিক-মানসিক বিপর্যয় মোকাবিলায় কাজ শুরু করেছে। ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প চলছে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে। সেখানেই চিকিৎসা নিতে আসছেন আহত ও দুর্বল মানুষরা। এদিকে ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, পোড়া বস্তিতে ভ্রাম্যমাণ শৌচাগার স্থাপন করা হয়েছে। ডিএনসিসিও তালিকা তৈরি করছে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তার জন্য ।
বনানী থানার ওসি রাসেল সরওয়ার বলেন, আগুন নির্বাপণের পর খোলা আকাশের নিচে থাকায় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে পুলিশ। দিন ও রাতে পালাক্রমে পুলিশ সদস্যরা সেখানে নিরাপত্তা দিচ্ছেন।
আনসারের মানবিক সেবাকেন্দ্র চালু : আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী জরুরি মানবিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে শুক্রবার কড়াইল বস্তির অভ্যন্তরে একটি মানবিক সেবাকেন্দ্র চালু করেছে। আনসারের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদের নির্দেশনায় শুক্রবার দুপুর ২টায় এ সেবাকেন্দ্রটির কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। ঢাকা মহানগর আনসারের পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান গনী এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন এবং তিনিই এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন।
আনসারের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ বলেন, এই সেবাকেন্দ্রের লক্ষ্য হলো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে প্রাথমিক মানবিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে জরুরি খাদ্য, পানি ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করে তাদের জীবনের নিরাপত্তা সহায়তা ও কিছুটা স্বস্তি নিশ্চিত করা।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে কড়াইল বস্তির বৌবাজার ইউনিটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। ১৯টি ইউনিটের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় আগুন ৫ ঘণ্টার মাথায় ওইদিন রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে আসে। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টায় পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয় এই আগুন।