Image description

ঢাকায় ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে একগুচ্ছ সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, ভূমি ব্যবহার জোনিং, বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে অনুসরণ, জলাধার রক্ষা, কাঠামোগত মূল্যায়ন ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ না নিলে বড় দুর্যোগে রাজধানী ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। তারা আরও বলেন, ঢাকাকেন্দ্রিক অতিরিক্ত উন্নয়ন রোধে বিকেন্দ্রীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পরিকল্পিত নগরায়ণ ও নিরাপদ আবাসনের সমান্তরাল নীতি গ্রহণই হতে পারে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি কমানোর কার্যকর উপায়।

শুক্রবার ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) অনলাইনে আয়োজিত সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা এসব সুপারিশ তুলে ধরেন।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধে আইপিডির পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকাকে টেকসই ও নিরাপদ করতে হলে ভূমি ব্যবহার জোনিং, বিল্ডিং কোড, মাটির ভূতাত্ত্বিক পরীক্ষা, কাঠামোগত মূল্যায়ন, অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং কমিউনিটির প্রস্তুতি সমন্বিতভাবে এগিয়ে নিতে হবে। নয়তো বড় ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ড বা বড় দুর্যোগে রাজধানীর ওপর বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

তিনি বলেন, ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। এজন্য ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড ও নির্মাণ বিধিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিবিআরএ) গঠন করে দ্রুত বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সিসমিক মাইক্রো জোনেশন ম্যাপ অনুযায়ী নগরায়ণ করতে হবে। জলাধার, জলাভূমি ভরাট করে কোনো সরকারি-বেসরকারি উন্নয়নই অনুমোদন করা যাবে না। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় কমিউনিটিকে প্রস্তুত করতে শিক্ষণ, ড্রিল ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। স্বল্প আয়ের লোকদের নিরাপদ ও সাশ্রয়ী আবাসনের জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। ভবন সংশ্লিষ্ট অনিয়মে যুক্ত কর্মকর্তা, সংস্থা বা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি কার্যকর করতে হবে।

তিনি বলেন, এখনই যদি ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বিভাগীয় ও জেলা শহরে পরিকল্পিত নগরায়ণ, নিরাপদ আবাসন, পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধা এবং কর্মসংস্থানের সমান্তরাল নীতি নেওয়া যায় তাহলে ১৫ থেকে ২০ বছরে আমরা ঢাকাকে কিছুটা চাপমুক্ত করতে পারব।

আইপিডির উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, চিলি-হাইতি-তুরস্কের ভূমিকম্পের উদাহরণগুলো স্পষ্ট দেখিয়ে দেয় ভূমিকম্প থেকে বাঁচতে বিল্ডিং কোড অনুসরণের গুরুত্ব কতটুকু। যে কোনো ভবন কিংবা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্যোগ ঝুঁকি কমানোর বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। ইমারত নির্মাণে সব পর্যায়ে দুর্নীতি মুক্ত করা যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব, ঠিক তেমনি ভবন মালিক ও পেশাজীবীদেরকেও দায়বদ্ধ করতে হবে।

বিআইপির সহসভাপতি পরিকল্পনাবিদ সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন বলেন, ঢাকা চট্টগ্রাম করিডরে যেভাবে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান বেড়েছে, দেশের অন্য এলাকায় সেভাবে বাড়ছে না। ঢাকার ওপর চাপ কমাতে দেশের স্থানিক পরিকল্পনা তৈরি করে দেশের অন্য অঞ্চলগুলোতে উন্নয়ন ছড়িয়ে দিতে হবে। মুনাফাকেন্দ্রিক নগরায়ণ মডেল থেকে রাষ্ট্রকে বের হয়ে আসতে হবে।

স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক ও আইপিডির রিসার্চ ফেলো কেএম আসিফ ইকবাল আকাশ বলেন, ঢাকাতে জনস্রোত না থামার অন্যতম কারণ অধিকাংশ বিভাগীয়, জেলা শহর ও প্রান্তিক জনপদে যথেষ্ট কর্ম ও মৌলিক চাহিদা পূরণের অপ্রতুলতা। জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ ঢাকাকে শুরু থেকেই বিকেন্দ্রীকরণ ও টেকসই উন্নয়নের ভেতর দিয়ে নিয়ে গেলে এখন তা মৃত্যুকূপে পরিণত হতো না। জলাশয় ভরাট করে নির্মিত উত্তরা দিয়াবাড়ী ৩য় প্রকল্পে মাইলস্টোন স্কুলের বিমান দুর্ঘটনা তারই সাক্ষ্য দেয়। ঢাকা যদি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় তার দায় যতটা নাগরিকের, তার ঠিক ততখানি সরকারেরও।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী ড. ফরহাদুর রেজা বলেন, ঢাকায় হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বাণিজ্যিক এলাকা নির্ধারণে জোনিং যথাযথ অনুসরণ করা হয় না। ফলে অগ্নিকাণ্ড বা ভূমিকম্প ঝুঁকি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

একিউমেন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ তাহের বলেন, ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর কাঠামোগত, ইলেকট্রিক্যাল ও অগ্নি নিরাপত্তাবিষয়ক বিশদ প্রকৌশল নিরীক্ষা অবিলম্বে করা প্রয়োজন।

শেলটেক কনসালট্যান্টের পুর প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ সজীব বলেন, ঢাকা শহরের জলাশয় জলাভূমি ভরাট করে গড়ে ওঠা জোনের নরম ও দুর্বল মাটিতে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে উন্নত ডিজাইন প্রটোকল অনুসরণ করতে হবে।

আইপিডি গবেষণা সহকারী জিনিয়াস জান্নাত বলেন, এখন থেকে পরিকল্পনামাফিক নগর গড়তে পারলে ঢাকা শহরকে নিরাপদ করা সম্ভব। আইপিডির সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে-ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করা, অগ্নিনিরাপত্তা অভিযান শক্তিশালী করা, ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়ানো, পুকুর ও খাল পুনরুদ্ধার করা, ডিজিটাল বিল্ডিং পারমিট করা। এছাড়া ভবন রেট্রোফিটিং প্রোগাম বাস্তবায়ন করা, পুরান ঢাকাসহ অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার পুনঃউন্নয়ন, ভূমি ব্যবহার শৃঙ্খলা, রেসকিউ রুট ও জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।