Image description
এক সপ্তাহে ৭ বার ভূমিকম্প

দেশে এক সপ্তাহে ৭ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এটি বড় মাত্রার ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। যদি তেমন কিছু হয়, তাহলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে দেশের শহরাঞ্চল। বিশেষ করে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। অথচ এ নিয়ে সরকারের কোনো প্রস্তুতি নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মাঝেও ভূমিকম্প সহনীয় কাজ বাস্তবায়নে অনীহা দেখা যাচ্ছে। এমন মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের।

তাদের মতে, ভূমিকম্প সহনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে সরকার বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) তৈরি করেছে। সেখানে ভবন নির্মাণের নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু তা মেনে ভবন তৈরি হচ্ছে না। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো মানহীন ভবন তৈরি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপও গ্রহণ করছে না। পাশাপাশি অসাধু ডেভেলপাররা অতি মুনাফার লোভে ভূমির গঠন ও মান বিবেচনা না করে যত্রতত্র বহুতল ভবন তৈরি করছে। হোলো ব্লকসহ বিভিন্ন ধরনের হালকা ব্লক ব্যবহারে সরকারের নির্দেশনা থাকলেও ইট ব্যবহার করে ভবনগুলো ভারী করে ফেলছে। ফলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার ৪০ শতাংশ অর্থাৎ সাড়ে ৮ লাখ ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তারা জানান, চলতি মাসে বারবার ভূমিকম্পের পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের ভূমিকম্পের ঝুঁকি, ঢাকাসহ সারা দেশের ভবনগুলোর ফিটনেস, ভূমিকম্প-পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতির বাস্তব চিত্র নিয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এখনো ধারাবাহিকভাবে লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু এতকিছুর পরও সরকারের কার্যত তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। বিদ্যমান অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সেসব বাস্তবায়ন করতে হবে। সেদিকে সরকার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে মনোযোগী হতে হবে। এখন কাজ শুরু করলেও মানসম্মত একটা পর্যায়ে পৌঁছাতে ১০-১৫ বছর লেগে যাবে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২১ নভেম্বর নরসিংদীর মাধবদীতে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এতে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় বড় কম্পন অনুভূত হয়। হেলে পড়ে অনেক ভবন। ওই ভূমিকম্পে ঢাকা, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জে ১০ জন নিহত হন। পরের দিন ২২ নভেম্বর সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর পলাশ। একই দিন সন্ধ্যায় ১ সেকেন্ডের ব্যবধানে প্রথমে ৩ দশমিক ৭ মাত্রায় ঢাকার বাড্ডায় এবং ৪ দশমিক ৩ মাত্রায় নরসিংদীতে ভূমিকম্প হয়। এরপর ২৬ নভেম্বর রাত ৩টা ২৯ মিনিটে বঙ্গোপসাগরে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল টেকনাফ থেকে ১১৮ কিলোমিটার দূরে। এর ঠিক এক মিনিট পরে ৩ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট। পরের দিন বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটের পর ৩ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর ঘাটাইল।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ভবন পরিদর্শন করে বিএনবিসি অনুসরণ না করে ভবন নির্মাণের শত শত প্রমাণ মিলেছে। নির্মাণগত ত্রুটির পাশাপাশি দুই হাজার ৬০৩টি ভবনে অগ্নিঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। আর নগরীর ৫৮টি বিপণিবিতানের সবকটিই কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৩৫টি, মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ ১৪টি এবং অতিঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় রয়েছে ৯টি। এছাড়া ২০২৪ সালে সারা দেশে ২৫২টি সরকারি এবং ৯২৯টি বেসরকারি মিলিয়ে এক হাজার ১৮১টি বহুতল ভবন (ছয়তলার ওপরে) পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। ওই সময় ৩৬৭টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৭৪টিকে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ভবন মালিকসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সুপারিশ পাঠানো হলেও কাউকে তা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউকের) আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে-১ হাজার ৮২৫টি স্থান থেকে মাটি নিয়ে পাঁচ ধরনের পরীক্ষা করা হয়েছে। এছাড়া পরীক্ষাগারে আরও ১০ রকমের পরীক্ষা করা হয়। এতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, বালু দিয়ে ভরাট এলাকা ভূমিকম্পের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ২৫২টি ভবন এবং রানা প্লাজা ধসের পর প্রায় ৩ হাজার ৫০০টি তৈরি পোশাক কারখানা নিয়ে জরিপ করা হয়। তবে এখনো পর্যন্ত আবাসিক ভবন নিয়ে কোনো কাজ হয়নি।

রাজউকের গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও মাদ্রাসা বোর্ডের ভবন রয়েছে।

এদিকে রাজউকের ভূমিকম্প সহনীয় দুর্যোগ নিরসনে নেওয়া প্রকল্প কার্যকর করতে মারাত্মক অনীহা লক্ষ করা যাচ্ছে। ভূমিকম্পে দুর্যোগঝুঁকি কমাতে রাজউক আরবান রিজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় কেনা ৬০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি তালাবদ্ধ পড়ে আছে। বেশির ভাগ যন্ত্রপাতির মোড়কই খোলা হয়নি। ব্যবহার না করায় সেগুলোর কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে। একই প্রকল্পের আওতায় ১২৫ কোটি টাকা খরচায় তৈরি ১০ তলা ভবনটি দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে।

এ বিষয়ে রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এবং সমাপ্ত আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের পরিচালক মো. আব্দুল লতিফ হেলালী যুগান্তরকে বলেন, ভূমিকম্প নিয়ে কাজ করতে মহাখালীতে একটি ভবন তৈরি করা হয়েছে। সেখানে একটি ট্রাস্ট গঠন করে দুর্যোগ সহনশীল ভবন নির্মাণ ও বিদ্যমান ভবনের মান যাচাই-বাছাই করার কথা। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সেগুলো সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতে রাজউক ও সরকার যদি সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে, তাহলে রাজধানীর ভবনগুলো অনেকাংশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সহনশীল হবে।

রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রাজউকের একটি প্রকল্পের আওতায় একটি ভবনসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ক্রয় করা হয়েছে। সেগুলো সবই ওই ট্রাস্টে দিয়ে দেওয়া হবে। পূর্ত সচিব ওই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান এবং রাজউক চেয়ারম্যান ওই প্রতিষ্ঠানের কো-চেয়ারম্যান হবেন।

বিশেষজ্ঞ অভিমত : এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক এম শামীমুজ্জামান বসুনিয়া যুগান্তরকে বলেন, ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিষয়ে ঢাকার কিছুটা প্রস্তুতি থাকলেও বড় মাত্রার ভূমিকম্প ঘটলে তা ম্যানেজ করার কোনো সক্ষমতা নেই। নতুন করে সক্ষমতা বাড়ানোরও কোনো উদ্যোগ সরকারের নেই। এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের আন্তরিক হতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেজিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান যুগান্তরকে বলেন, বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হলে তা ম্যানেজ করার কিছুটা প্রস্তুতি ফায়ার সার্ভিসের রয়েছে। তবে সেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ভলান্টিয়ারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত রাখতে হবে।

বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)-২০২০ প্রণয়নসংক্রান্ত স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য সচিব এবং হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবু সাদেক যুগান্তরকে বলেন, বিএনবিসি ভবনের গাইড বুক। সেখানে এলাকাভেদে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বিবেচনায় নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। সেগুলো মেনে ভবন তৈরি করলে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকবে ভবনগুলো। আর বিএনবিসি অনুসরণ না করলে উচ্চমাত্রার কম্পনে সেসব টিকবে না।