Image description

ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষত কাটিয়ে উঠে ফের প্রস্তুত হচ্ছে জাতীয় সংসদ ভবন। ডিসেম্বরের মধ্যে ভবনটির ভেতর ও বাইরে সংস্কারকাজ শেষ করার যাবতীয় প্রস্তুতি পুরোদমে এগিয়ে চলছে। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নেওয়া হয়েছে এই ত্বরিত উদ্যোগ। ইতোমধ্যে সংসদ ভবন এলাকায় অবস্থিত স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনের সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে। সংসদের ভেতরে অবস্থিত স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ এবং অন্যান্য হুইপ ও সংসদ সচিবালয় কর্মকর্তাদের কার্যালয় সংস্কারসহ ভবনের প্রায় ৭০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট কাজও দ্রুততার সঙ্গে শেষ করতে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। প্রায় অচল হয়ে পড়া ভবনটিকে আবারও সচল ও প্রযুক্তিনির্ভর কাঠামোয় ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট সংসদ সচিবালয়। তবে অধিবেশন কক্ষসহ ভবনের সাউন্ড সিস্টেম নতুন করে চালু করার বিষয়টি এখনো থেমে আছে। পুরো কাজ শেষ করতে খরচ হবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। সংসদ সচিবালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথম পর্যায়ে জাতীয় সংসদ ভবনে ক্ষতিগ্রস্ত কম্পিউটার, প্রিন্টার, স্ক্যানার, ইন্টারনেট সংযোগ, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, লাইন ও সেটগুলো মেরামত করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে নবমতলার সাব-স্টেশন, এমপি রুম, অভ্যর্থনা কক্ষ, গণপূর্ত সার্কেল অফিসসহ মসজিদসংলগ্ন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অফিসের বৈদ্যুতিক কাজ, বিভিন্ন ব্লকের মেইন সার্ভিস লাইন, সুইচ, সকেট, পয়েন্ট ওয়্যারিং, এলইডি লাইট, টিউবলাইট, সার্কিট ব্রেকার সরবরাহ এবং সংস্কারের কাজ শেষ করেছে সংসদ সচিবালয়। সংসদ ভবনের টেলিফোন ও আইটি নেটওয়ার্ক নতুনভাবে স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপন, নতুন দরজা-জানালা লাগানো, বিভিন্ন দপ্তরের মেরামত এবং আসবাবপত্র কেনাকাটার কাজও শেষ পর্যায়ে।

এছাড়াও রাস্তা, মাঠ, গেট, লেক, সিকিউরিটি লাইট, ফোকাস লাইট, স্ট্রিট লাইট, গার্ডেন লাইট, সার্ভিস লাইন, সার্কিট ব্রেকার স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। সিকিউরিটি গেট, পোস্টের মেটাল গেট ও গার্ডেনের বৈদ্যুতিক কাজ, বিভিন্ন ব্লকের লিফটের যন্ত্রাংশ, এডিআর, সড়কবাতি ও ফ্লাডলাইট, সিসিটিভি পরিবর্তনসহ আনুষঙ্গিক বৈদ্যুতিক কাজও শেষ পর্যায়ে। এর বাইরে সংসদ ভবনের সচিব হোস্টেল, এলডি হল, মেডিকেল সেন্টার, মিডিয়া সেন্টার, টিভি স্টুডিও, ব্যাংকের বৈদ্যুতিক স্থাপনা, সংসদ সচিব ও যুগ্মসচিব হোস্টেল, কর্মচারী কোয়ার্টারের বৈদ্যুতিক স্থাপনার মেরামতের কাজও শেষ করেছে সংসদ সচিবালয়। সংসদ ভবনের গেট নম্বর ১, ৬, ৭ ও ১২-এর জন্য স্ক্যানার এবং আর্চওয়ে স্থাপন, সিকিউরিটি ডিভাইসের বৈদ্যুতিক স্থাপনা, প্ল্যানারি হলের ক্ষতিগ্রস্ত কনফারেন্স সিস্টেম পরিবর্তন এবং বিভিন্ন কমিটি কক্ষের কনফারেন্স সিস্টেম পরিবর্তনের কাজও শেষ পর্যায়ে। তবে এখনো সংসদ-সদস্যদের জন্য নির্ধারিত এমপি হোস্টেলের বেশকিছু কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। সূত্র জানায়, এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই সংসদ ভবনের ভেতরে-বাইরে যাবতীয় সংস্কারকাজ শেষ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে।

জানা যায়, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ভাঙচুর ও লুটপাটে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া জাতীয় সংসদ ভবন পুনরায় ব্যবহারোপযোগী করতে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। সংসদ সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। পুরো সংসদ ভবন মেরামতের বড় কাজ রয়েছে গণপূর্ত বিভাগের হাতে। এর পরের কাজ সংসদ সচিবালয়ের আইটি খাতের এবং বাকিটা সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো করবে।

ওই কর্মকর্তা জানান, ৫ আগস্টের ঘটনার পর সংসদ ভবনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর একটি সভা হয়। সভায় সংসদ ভবনে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়। সভায় জানানো হয়, ঘটনার দিন তছনছ করা হয় সংসদ ভবনের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, হুইপ, সংসদীয় কমিটির দপ্তর, আইটি সেন্টার ও ভিআইপি কক্ষগুলো। ধ্বংস হয়ে যায় এসি, কম্পিউটার, ই-ভোটিং প্রযুক্তি, সম্প্রচারব্যবস্থা ও টেলিকম সংযোগ। সংসদের অধীন এমপি হোস্টেল এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীর আবাসিক ভবনেও বিক্ষুব্ধ জনতা ভাঙচুর চালায়। লুট হয়েছে আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি এবং গুরুত্বপূর্ণ ফাইল। এছাড়া সরকারি ও ব্যক্তিগত তহবিলসহ প্রায় ৯০ লাখ টাকা লুট হয়। এ সময় সংসদ ভবনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অফিস থেকে হারিয়ে যাওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত মালামালের বিস্তারিত তালিকা তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয়। সংসদ সচিবালয় গঠিত কমিটি প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পাশাপাশি পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ পেশ করে। এর আলোকে প্রাথমিকভাবে ৩০০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়। সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার সময়সীমা ধরা হয়েছে ডিসেম্বর ২০২৫। সে অনুযায়ী ধাপে ধাপে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সংস্কারকাজ এগিয়ে চলছে।

সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো জানিয়েছে, এক্সেস কন্ট্রোল, আর্চওয়ে, ব্যাগেজ স্ক্যানার, সিসিটিভি, নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক ছাড়াও নতুন করে বসানো হবে সাইমুলটেনিয়াস ইন্টারপ্রেটেশন সিস্টেম। অর্থাৎ অত্যাধুনিক এই সিস্টেম চালু হলে জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তব্য কেউ চাইলে যে কোনো ভাষায় শুনতে পারবে। একই সঙ্গে ই-পার্লামেন্ট চালু করা হবে। এসব সিস্টেমের যন্ত্রপাতি কেনাকাটার জন্য তালিকা তৈরি করে জরুরি ভিত্তিতে অনুমোদন চাওয়া হয়েছে।

সংসদ সচিব কানিজ মাওলা সরকারি সফরে বর্তমানে ইতালিতে অবস্থান করছেন। এজন্য তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এ প্রসঙ্গে সংসদ সচিবালয়ের উপসচিব মাহবুব জামিল মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্টের ঘটনায় সংসদ ভবনের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করেছি। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষ করে এনেছি। যত দ্রুত সম্ভব অবশিষ্ট কাজও শেষ করার প্রস্তুতি চলছে।’

শেরেবাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. লতিফুল ইসলাম বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই আমরা সংসদ ভবনকে শতভাগ প্রস্তুত রাখার চেষ্টা করছি। আমাদের লক্ষ্য ডিসেম্বরের মধ্যেই কাজ শেষ করা। যদি কোনো কারণে তা সম্ভব না হয়, তাহলে জানুয়ারির মধ্যে অবশ্যই সব কাজ শেষ করা হবে। তিনি জানান, ইতোমধ্যে বেশির ভাগ কাজ প্রায় শেষ হয়েছে।

প্রসঙ্গত, নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছর ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এদিন তিনি হেলিকপ্টারে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা জাতীয় সংসদ ভবনের ভেতরে ঢুকে ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এতে সংসদ ভবনের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

বিক্ষুব্ধ জনতা কম্পিউটার, এসি, বিভিন্ন ইলেকট্রিক সামগ্রী, আসবাবপত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ ও দামি জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। খুলে নিয়ে যায় বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের তার এবং সাউন্ড সিস্টেম। সংসদ ভবনের গেটে দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রথমে প্রবেশে বাধা দিলেও একপর্যায়ে জনরোষের মুখে তারা পালিয়ে যান। সংসদ ভবন চত্বরের দক্ষিণ প্লাজা, খেজুর বাগান মাঠ ও টানেলে ঢুকে পড়লে জনস্রোত উপচে পড়ে। এ সময় অনেকে সংসদের মূল ভবনেও ঢুকে পড়েন। এরপর অধিবেশন কক্ষে গিয়ে তারা সংসদনেতা, স্পিকার এবং সংসদ-সদস্যদের চেয়ারে বসে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে নানা স্টাইলে ছবি তোলেন। অধিবেশন কক্ষে নানা ধরনের স্লোগানও দেওয়া হয় এ সময়।

সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্ট হামলা-ভাঙচুর এবং লুটপাটের কারণে সংসদ সচিবালয়ের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়। দুদিন পর সংসদ সচিব মন্ত্রী হোস্টেলে কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন। এরপর ভবন কিছুটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ১৮ আগস্ট থেকে আংশিক কার্যক্রম শুরু হয়। তবে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে সংসদ সচিবালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করতে বেশ দেরি হয়। এর মধ্যে লুট হওয়া কিছু জিনিসপত্র উদ্ধার করা গেলেও সেগুলোর বেশির ভাগই ছিল ব্যবহারের অযোগ্য। ফলে নতুন করে কেনাকাটা এবং ভবনের সংস্কারকাজ শুরুর জন্য অপেক্ষা করতে হয় সংসদ সচিবালয়কে।