আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরগরম দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। প্রায় ১৬ বছর পর দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের অপেক্ষায় রয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোও পুরোপুরি নির্বাচনমুখী। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোটগ্রহণের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশনও। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হতে পারে তফশিল। কিন্তু এতসব আয়োজনের মধ্যে শঙ্কার জায়গাও রয়েছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে অন্তত তিনটি বড় বাধা দেখছেন পর্যবেক্ষকরা। এর মধ্যে রয়েছে-অবৈধ অস্ত্র, নাশকতা ও দলীয় কোন্দল। এসব দূর করতে না পারলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা। তাদের মতে, বহুলপ্রত্যাশিত আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই বাধাগুলো দূর করতে হবে। তবেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে। পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনে প্রথম বাধা হিসাবে চিহ্নিত করছেন অবৈধ অস্ত্র।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশের ৫ হাজার ৭৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ৫২ হাজার ৮টি গুলি লুট হয়। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৪২৩টি উদ্ধার হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৩৪০টি এখনো সন্ত্রাসী ও নাশকতাকারীদের হাতে। উদ্ধার না হওয়া অবৈধ অস্ত্র নানা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে বিভিন্ন সময় পুলিশের তরফ থেকেও বলা হচ্ছে। এছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে সীমান্ত দিয়েও অবৈধভাবে অস্ত্র বাংলাদেশে ঢুকছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এসব অস্ত্র নির্বাচনে ব্যবহারের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পাশাপাশি গত বছরের ৫ আগস্টের পর কিছু কিছু ক্ষেত্রে মব জাস্টিজ বা মব সন্ত্রাসও হচ্ছে। ঘটছে গণপিটুনির মতো ঘটনা। এর নেপথ্যে কারা, তা খুঁজে দেখছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচন ঠেকাতে পতিত আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকরা নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করছে। তাই ভোটকে কেন্দ্র করে আছে নাশকতার শঙ্কাও। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের সব বিভাগকে একযোগে কাজ করতে হবে মলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলও ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে এসব বাধা ও প্রতিবন্ধকতা দ্রুত সময়ের মধ্যে চিহ্নিত করে তা নিরসনে কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান পর্যবেক্ষকরা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হবে অবৈধ অস্ত্র। শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের সন্ত্রাসীদের হাতেও অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। এখন থেকেই এসব অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করতে হবে। তারা বলেন, নাশকতা কঠোরভাবে ঠেকাতে হবে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে। এবারের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব অনেক। ভোটের পরিবেশ ঠিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতার পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধে যেন পরিবেশ বিঘ্নিত না হয়, সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ প্রমাণ করে আমরা অপরাধের একটি অভয়ারণ্য তৈরি করে দিয়েছি। এই সময়কে তারা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাচ্ছে এবং সহিংসতার ঘটনা চরম পর্যায়ে বাড়ছে। প্রতিটি ঘটনা রাজনৈতিক বিষয় ও অস্থিতিশীলতাকে কেন্দ্র করে ঘটছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দলগুলো যদি মতৈক্যে না আসতে পারে, তাহলে সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড বাড়বে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সরকারের পক্ষে সুষ্ঠু-স্বাভাবিক নির্বাচন করা খুবই কঠিন ও দুরূহ ব্যাপার হবে বলে আমি মনে করি।
সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম যুগান্তরকে বলেন, ‘আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে চ্যালেঞ্জ নিশ্চয়ই আছে। তবে আমার মনে হয়, সবাই যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকি, তাহলে এটা মোকাবিলা করা অতি কঠিন হবে না। কেননা শেখ হাসিনার রায়কে কেন্দ্র করে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল, তা বাংলাদেশ পুলিশ, সেনাবাহিনী, গোয়েন্দাসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব সদস্য মিলে ভালোভাবে মোকাবিলা করেছেন। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও তেমন ধর্তব্য বলে আমি মনে করি না।
এদিকে যে কোনো নাশকতা ঠেকাতে পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) মো. রেজাউল করিম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, লুট হওয়া অস্ত্র ও গুলির একটি বড় অংশ উদ্ধার হয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারসহ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলমান আছে। এটা আরও বাড়ানো হবে। লুট হওয়া অস্ত্রগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হচ্ছে এমন কোনো তথ্য এখনো পাননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনে এসব অস্ত্র কোনো সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনকেন্দ্রিক অপতৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে ওরা বিভিন্ন ঘোষণা দিয়ে আসছে। নেতাকর্মীদের চাঙা করার জন্য এগুলো রাজনৈতিক কথাবার্তা। তবে তাদের সেই সক্ষমতা নেই। হাসিনার রায়ের আগেও তারা অনেক কিছু করে ফেলবে-এমন ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু কি করতে পেরেছে?
অবৈধ অস্ত্র : পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও স্থাপনায় হামলা চালায় বিক্ষুব্ধরা। এ সময় পুলিশের ৫ হাজার ৭৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ৫২ হাজার ৮টি গুলি লুট হয়। পরে এসব অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে তথ্য পেতে পুরস্কারও ঘোষণা করে সরকার। এরপরও লুণ্ঠিত গুলির মধ্যে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭২৮টি উদ্ধার হয়েছে। অর্থাৎ এখনো ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৮০টি গুলির হদিস মেলেনি। এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখন সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অস্ত্র ঢুকছে। এসব অস্ত্রও আগামী নির্বাচনে ব্যবহার করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারকে কঠোর হতে হবে।
মব ও নাশকতা : মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১৬৫ জন। চলতি বছরের এ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকাতে সবচেয়ে বেশি ৭২ জন নিহত হয়েছেন। এরপর চট্টগ্রামে ২৮, খুলনায় ১৭, বরিশালে ১৪, রাজশাহীতে ১৩, ময়মনসিংহ ১০, রংপুর ৭ এবং সিলেটে চারজন নিহত হন। খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও মবের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরে সারা দেশে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ৫৩১টি মামলা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের মামলার পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১০ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) সারা দেশে ২ হাজার ৯৬৯টি হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। এছাড়া দেশে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটছে। রাজধানীসহ সারা দেশে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রভাব বেড়েছে। তুচ্ছ ঘটনায় ঘটছে খুনোখুনি। সোমবার রাতেও রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাবার সামনে ছেলে বাবুকে গলা কেটে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি বেশি দরকার। এ ছাড়া নির্বাচন বানচালে ইতোমধ্যে গভীর ষড়যন্ত্রে নেমেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক অডিও রেকর্ডে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা গেছে, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কিভাবে নির্বাচন হয় তা দেখে নেওয়া হবে।
দলীয় কোন্দল : নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় কোন্দল যেন থামছেই না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের বারবার তাগিদ দিচ্ছে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। ভালো কাজের দ্বারা জনপ্রিয়তা অর্জন করে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায় বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারকদের এই প্রত্যাশা পূরণে ‘বাধা’ হয়ে দাঁড়িয়েছেন মাঠপর্যায়ের কিছু নেতাকর্মী। যাদের বেশির ভাগ দলের ‘হাইব্রিড’ হিসাবে পরিচিত। তাদের নানা অপকর্মসহ বিভিন্ন কারণে বিএনপিতে মাথাচাড়া দিচ্ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এতে করে কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন হচ্ছে দলের ভাবমূর্তি। গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর সারা দেশে অন্তত ৪০টি বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ২৩৬ আসনে প্রাথমিক একক প্রার্থী ঘোষণার পর বিরোধ আরও প্রকাশ্যে আসছে। অন্তত ৪০টি আসনে অভ্যন্তরীণ বিরোধ এখন চরমে। কর্মীদের মধ্যে রেষারেষি, নেতাদের মধ্যে বিরোধ, স্বার্থের দ্বন্দ্বে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংর্ঘষে নিহত ও আহতের সংখ্যাও বাড়ছে। যদিও বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করছে। এসব আসন মনিটরিং করছেন দায়িত্বশীল নেতারা। তবে নির্বাচন চলার সময় বিএনপি বিরোধ কতটুকু থামাতে পারবে সে বিষয়ে অনেকের সংশয় রয়েছে। আবার কয়েকটি জায়গায় জামায়াতেরও অভ্যন্তরীণ বিরোধ সামনে আসছে।
অন্যদিকে, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যেও বেশকিছু জায়গায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আসনভিত্তিক কয়েকটি জায়গায় দুদল মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এমতাবস্থায় বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দ্বন্দ্ব নির্বাচনের সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। দুদলের এই বৈরিতার প্রভাব ভোটকেন্দ্রেও পড়তে পারে বলেও মনে করেন অনেকে। তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিও কয়েকটি জায়গায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। এক্ষেত্রে নির্বাচনে সহিংসতা হবে না-এই মর্মে দলগুলোকে একমত হতে হবে। যদিও বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি-এ তিন দলের নেতারা বলছেন আইনশৃঙ্খরা বাহিনীকে দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। তারা এ ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা করবেন।
অবশ্য বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, সারা দেশে মুষ্টিমেয় নেতাকর্মীর নেতিবাচক কাজের দায় দলের সবাইকে নিতে হচ্ছে। বিএনপির নাম ভাঙিয়ে ‘তৃতীয় পক্ষ’ অবৈধ সুযোগ নেওয়ার অপচেষ্টা করছে। আবার কোনো কিছু ঘটলেই বিএনপির ওপর দায় চাপানোর জন্য একটি পক্ষ সব সময়ই বসে থাকে; যা দুঃখজনক। বিএনপির যারা প্রকৃত নেতাকর্মী, তারা কোনো অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। বরং কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বহুমুখী পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে দলটি।