‘আপনি থানার মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করছেন। ছাত্রলীগের ভাইব্রাদারকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করছেন। মিথ্যা মামলায় ঢুকাচ্ছেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী সংগঠনের মতো আচরণ করছেন। আপনাকে চাকরি কিন্তু ৩০ বছর করতে হবে। বাংলাদেশের মধ্যেই আপনাকে থাকতে হবে। পরিবার নিয়ে কিন্তু বের হতে পারবেন না। এটা মনে রাইখেন।’ সম্প্রতি এভাবেই গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মনির হাসানকে ফোন করে হুমকি দেন এক ব্যক্তি। একই ধরনের হুমকি দেওয়া হয়েছে রাজধানীর গুলশান থানার ওসিকে।
প্রতিনিয়ত পুলিশের অসংখ্য সদস্যকে এভাবেই ফোনসহ নানা কায়দায় হুমকি দিচ্ছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাকর্মীরা। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে পুলিশ কঠোর অবস্থান নেওয়ায় এমন হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। এসব হুমকির ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভারতীয় ফোন নম্বর ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান তারা। এসব সিম কার নামে রেজিস্ট্রেশন করা তা জানতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
সূত্র বলছে, নাশকতাকারীদের গ্রেফতারে মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় শক্ত ভূমিকা রাখা পুলিশ কর্মকর্তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে। এমনকি তাদের পরিবারকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরও তাদের ক্ষতি করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পলাতক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হুমকির কলরেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে তারা। এতে নিজের নিরাপত্তার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়েও মাঠপর্যায়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দুশ্চিন্তা। নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করছেন ভুক্তভোগী পুলিশ সদস্যরা। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলেন, মাঠপুলিশ সদস্যদের মানসিক চাপে ফেলতে পতিত আওয়ামী লীগের পলাতক দুষ্কৃতকারীরা এ ধরনের কাজ করছে। সম্প্রতি পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের অভ্যন্তরীণ এক সভায় মাঠপুলিশের নিরাপত্তার বিষয়টি নজরে আনেন এক পুলিশ সুপার। এ নিয়ে করণীয় নির্ধারণে আলোচনাও হয়েছে। তবে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ইউনিট প্রধানদের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি এখনো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের হুমকি মানসিক চাপ তৈরি করে। যদি কেউ মনে করে এই হুমকির ওপর তার নিয়ন্ত্রণ আছে তাহলে ‘মেনটাল স্ট্রেচ’ কম হবে। এক্ষেত্রে তার সেফটি ও সিকিউরিটি নিশ্চিত করা হলে এ ধরনের হুমকিগুলো তার কাছে কোনো ব্যাপার নয়।
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা যুগান্তরকে বলেন, হুমকি দেওয়া ক্রিমিনাল অফেন্স। এক্ষেত্রে হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। এর আগেও পুলিশকে টার্গেট করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে পুলিশ যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, সেই মুহূর্তে পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন ফেসবুক পেজে টার্গেট করে পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম ও ছবি প্রকাশ করে নানা হুমকি দেয়। তখন বিভিন্ন থানার ওসি, এসআই থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) পর্যন্ত শতাধিক কর্মকর্তার ছবি বিভিন্ন ফেসবুক আইডি ও পেজে শেয়ার করে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মনির হাসানকে ফোন করা ব্যক্তি নিজেকে টুঙ্গিপাড়ার একজন সাধারণ নাগরিক বলে পরিচয় দেন। গত ৭ নভেম্বর রাজ.৭১ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে ৬ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের সেই কথোপকথন ছেড়ে দেওয়া হয়। যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়।
ফোনে হুমকির বিষয়টি নিশ্চিত করে এসআই মনির হাসান যুগান্তরকে বলেন, ‘এখানে সন্ত্রাস দমন আইনের বেশকিছু মামলা ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আমি। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোনে নানা ধরনের হুমকি দেয়।’ ফোনে হুমকি দেওয়া ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইলে এসআই মনির বলেন, ‘জানতে পেরেছি পাশের কোটালিপাড়া থানায় তার বাড়ি। নাম ইমরান হোসেন রাজিব।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমানকে ফোন করেন এক ব্যক্তি। নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী গ্রেফতার করায় ওসিকে হুমকি দেন তিনি। ওসির সঙ্গে কথোপকথনের অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখানে জনৈক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনি যে শহরে চাকরি করেন সেই শহরের হর্তাকর্তা আমি-আমার মতো রাজনীতিবিদরা। টুডে অর টুমোরো আমরা এমপি মন্ত্রী হবো। চাকরি কয়দিন আছে, ওসিগিরি কয়দিন করবেন। আপনার চৌদ্দগোষ্ঠীর খবর আছে আমাদের কাছে। আপনারও পরিবার আছে, আমরা কিন্তু ছাড়ব না।’
ফোনে হুমকির বিষয়টি নিশ্চিত করে গুলশান থানার ওসি হাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে জিডি করে সিনিয়র স্যারদের অবগত করে রেখেছি। প্রতি রাতেই ইন্ডিয়ান নম্বর থেকে ফোনে এমন হুমকি পাচ্ছি।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) মো. রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন নই। মামলা নেওয়ার মতো বিষয় হলে মামলা নেওয়া হয়, জিডি নিয়েও ইনকোয়ারি করা হয়। কার নামে সিম রেজিস্ট্রেশন করা তা জানতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে কনসার্ন দেশ থেকে জানার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।