গুমের অভিযোগের মামলায় টেলিযোগাযোগ নজরদারির জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানের জন্য বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা হয়েছে।
রবিবার (২৩ নভেম্বর) চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ এই আবেদন করা হয়।
ট্রাইব্যুনালে জিয়াউল আহসানের পক্ষে আবেদনটি করেন আইনজীবী নাজনীন নাহার। এসময় প্রসিকিউশন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামসহ অন্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন।
এদিন আইন অনুসরণ না করে মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অভিযোগ করেছেন তার বোন ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাজনীন নাহার।
ট্রাইব্যুনালকে আইনজীবী নাজনীন বলেন, জিয়াউল আহসানকে নিয়মবহির্ভূতভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা কিংবা প্রসিকিউশনের লোকজনের বাইরে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিসও তাকে (জিয়াউলকে) জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় নাবিলা ইদ্রিসের সেখানে থাকার জন্য ট্রাইব্যুনালের অনুমতি ছিল কিনা, সেটা তিনি জানেন না। জিজ্ঞাসাবাদের সময় জিয়াউলকে হুমকিও দেন নাবিলা।
পরে এ বিষয়ে প্রসিকিউশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ট্রাইব্যুনাল।
তখন চিফ প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তথ্য উদঘাটনের জন্য ভুক্তভোগীদের আনেন তদন্ত কর্মকর্তা। আর নাবিলা ইদ্রিস ঘটনা সম্পর্কে জানেন। একপর্যায়ে জিয়াউল আহসানকে নিয়ে একটি মন্তব্য করেন চিফ প্রসিকিউটর। সেই মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন নাজনীন নাহার।
এরপর নাজনীনের উদ্দেশে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আপনাকেও (নাজনীন) আসামি করা হতে পারে। তদন্তে আপনার বিষয়ে তথ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।’ জবাবে নাজনীন নাহার বলেন, করেন।
ট্রাইব্যুনালকে তাজুল ইসলাম বলেন, তার (নাজনীন) সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে নানা জায়গায়। জিয়াউল প্রায় এক হাজার মানুষকে হত্যা করেছে একাই। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ভুক্তভোগীকে আনা হয়েছে, তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে।
এ পর্যায়ে চিফ প্রসিকিউটরকে উদ্দেশ করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে আসামি করবেন, এখনতো আইনজীবী।
এদিকে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের আবেদনের বিষয়ে শুনানিকালে আইনজীবী নাজনীন ট্রাইব্যুনালকে বলেন, জিয়াউলের পক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগে বার কাউন্সিলের অনুমতি নিতে আবেদন প্রক্রিয়ার করার জন্য জেল কর্তৃপক্ষসহ কয়েক জায়গায় সই প্রয়োজন।
পরে প্রচলিত আইন মেনে সেসব সই নেওয়ার অনুমতি দেন ট্রাইব্যুনাল-১।
শুনানি শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ ফলপ্রসূ করার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা যাকে প্রয়োজন মনে করবেন, তাকেই পাশে রাখতে পারবেন। ভুক্তভোগীর মুখোমুখি হলে আসামি সত্য বলতে বাধ্য হন। এরকম প্রক্রিয়া তদন্ত সংস্থা অনুসরণ করছে।
প্রসঙ্গত, বিগত আওয়ামী লীগের টানা ক্ষমতায় থাকতে টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) ও জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) বিরোধী মতাদর্শের লোকদের তুলে নিয়ে গুম-নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পৃথক দুই মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাবেক-বর্তমান সেনা কর্মকর্তাদের শুনানির দিন ধার্য রয়েছে আজ। এ দুই মামলায় গ্রেফতার রয়েছেন ১৩ সেনা কর্মকর্তা।
গ্রেফতার ১৩ সেনা কর্মকর্তা হলেন—র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, ব্রিগেডিয়ার কেএম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসরকালীন ছুটিতে), র্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী।
এর আগে গত ৮ অক্টোবর পৃথক দুই মামলায় মোট ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। পরে অভিযোগ আমলে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। র্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশনের (টিএফআই) গোপন সেলে বন্দি রেখে নির্যাতনের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ১৭ জনকে আসামি করা হয়।
আসামিরা হলেন—শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ, র্যাবের সাবেক ডিজি এম খুরশিদ হোসেন, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদ, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম, তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, র্যাব কর্মকর্তা কেএম আজাদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কামরুল হাসান, মাহবুব আলম, আবদুল্লাহ আল মোমেন, সারোয়ার বিন কাশেম, খায়রুল ইসলাম, মশিউর রহমান জুয়েল ও সাইফুল ইসলাম সুমন। এর মধ্যে গ্রেফতার রয়েছেন ১০ সেনা কর্মকর্তা।
এছাড়া জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি) বা আয়না ঘরে গুমের অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেক মামলায় ১৩ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলায়ও শেখ হাসিনা-তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নাম রয়েছে।
অন্য আসামিরা হলেন—ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) লে. জেনারেল (অব) মোহাম্মদ আকবর হোসেন, সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব) সাইফুল আবেদিন, লে. জেনারেল (অব) মো. সাইফুল আলম, সাবেক ডিজি লে. জেনারেল তাবরেজ শামস চৌধুরী, সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব) হামিদুল হক, মেজর জেনারেল তৌহিদুল ইসলাম, মেজর জেনারেল সরওয়ার হোসেন, মেজর জেনারেল কবির আহাম্মদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভীর মাজহার সিদ্দিকী ও লে. কর্নেল (অব) মখসুরুল হক। এ মামলায় তিনজন কারাগারে থাকলেও বাকিরা পলাতক রয়েছেন।
গত ২২ অক্টোবর সেনা হেফাজতে থাকা ১৩ কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। শুনানি শেষে তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে পলাতক আসামিদের হাজিরের জন্য সাতদিনের মধ্যে দুটি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়।