Image description

নির্বাচন সামনে রেখে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে টার্গেট কিলিং। প্রকাশ্যে ফিল্মি কায়দায় গুলি করে হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা ঘটছে। এসব অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে ভাড়াটে খুনি। অপরাধ বিশেষজ্ঞ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র বলছে, আধিপত্য বিস্তার, আন্ডারওয়ার্ল্ডের দখল, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ব্যক্তিগত শত্রুতা এবং ঢালাও জামিনে বের হওয়া কুখ্যাত অপরাধীদের কারণে টার্গেট কিলিং দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এসব ঘটনা একদিকে জনমনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেও করছে প্রশ্নবিদ্ধ।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা নেই। তিনি দাবি করেন, গত দেড় বছরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

জানা গেছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ফিল্মিস্টাইলে গুলি, কুপিয়ে হত্যা, অপহরণের পর খুন, অজ্ঞাত স্থান থেকে লাশ উদ্ধার হচ্ছে। এসব ঘটনা জনমনে ভয়, আতঙ্ক এবং অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলছে। নির্বাচন সামনে রেখে অপরাধীচক্র, আন্ডারওয়ার্ল্ডের একাধিক গ্রুপ ও রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী চক্র মাঠে নেমেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, রাজনৈতিক বিভক্তি মাঠপর্যায়ের দুর্বলতাকে আরও জটিল করে তুলছে। তারা বলছেন, মাঠপুলিশের মধ্যে দুটি বিশেষ দলের সমর্থক পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় পোস্টিং পেয়েছেন। তারা তাদের আদর্শের লোকজনের পক্ষে কাজ করছেন। ফলে সাধারণ মানুষ প্রায়ই আইনি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গত ১৫ দিনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৩৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। নদী থেকে লাশ উদ্ধার, ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, ঘরে ঢুকে কুপিয়ে হত্যা-সব ধরনের ঘটনাই ঘটছে। গত ১০ নভেম্বর পুরান ঢাকার আদালত পাড়ায় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আন্ডারওয়ার্ল্ডের আধিপত্যের জেরেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন মামুন।

এছাড়া ১১ নভেম্বর গুলশানে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সৌরভ নামে এক ছাত্রদল নেতাকে। একই দিন মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে সাব্বির নামে এক ছাত্রদল নেতার লাশ উদ্ধার করা হয়। ১২ নভেম্বর বাড্ডায় একটি মেস বাসায় ঢুকে মামুন সিকদার নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৬ নভেম্বর মিরপুরের পল্লবীতে যুবলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গত ১৭ নভেম্বর জাতীয় ঈদগাহের সামনে দুটি নীল রঙের ড্রাম থেকে উদ্ধার করা হয় ২৬ টুকরো লাশ। ব্যবসায়ী আশরাফুল হককে হত্যা করে দেহ টুকরো করে ড্রামে ভরে ফেলে রেখে যায় খুনিরা। এমন দৃশ্য দেশের ইতিহাসে বিরল। নৃশংসতার এই নতুন মাত্রায় শিউরে উঠছেন মানুষ। অবশ্য এ ঘটনায় দুজন গ্রেফতার হয়েছেন।

গত ১১ নভেম্বর ক্যামব্রিয়ান কলেজের শিক্ষার্থী সুদীপ্ত রায়কে অপহরণের পর ৮০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা না পেয়ে দিয়াবাড়ি এলাকার একটি ফ্ল্যাটে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়া যাত্রাবাড়ীতে চোর সন্দেহে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ।

চট্টগ্রামের রাউজানে চারাবটতলা এলাকায় গত ২৫ অক্টোবর স্ত্রী সন্তানের সামনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন যুবদল কর্মী আলমগীর। এর আগে ৭ অক্টোবর রাউজান থেকে চট্টগ্রাম শহরে ফেরার পথে মদনাঘাটে ফিল্মিস্টাইলে বিএনপি কর্মী আব্দুল হাকিমকে গুলি করে হত্যা করে স্বশস্ত্র দুর্বৃত্তরা। এর আগে রাউজানের নওয়াপাড়ায় দিনদুপুরে খুন হন শুঁটকি ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম। সম্প্রতি রাজশাহীতে এক শিক্ষককে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা দেশে অহরহ ঘটছে।

এদিকে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতাও থেমে নেই। একটি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গত অক্টোবর মাসে দেশে কমপক্ষে ৬৮টি ‘রাজনৈতিক সহিংসতার’ ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪শ জন। এসব সহিংসতার মধ্যে ২৫টি ঘটেছে বিএনপির আন্তঃকোন্দলের কারণে। এ ছাড়া বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ২৬টি, বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে ৩টি ও আওয়ামী লীগের আন্তঃকোন্দলে ১টি সহিংসতা ঘটে। অন্য ১৩টি ঘটনা ঘটেছে অন্যান্য দল ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে। আর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন বলছে, দেশে গত ১০ মাসে ৩৫১টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় প্রাণ গেছে ৯০ জনের, আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৮৩৫ জন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জুলাই আন্দোলনের পর ৫ আগস্ট ও পরবর্তী সময়ে দেশব্যাপী বিভিন্ন থানা ও কারাগার থেকে লুট হওয়া অস্ত্র এখন অপরাধীদের হাতে নতুন শক্তি জোগাচ্ছে। পুলিশের এক হিসাবে দেখা গেছে, থানাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনা থেকে লুট হয়েছিল ৫ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র। এর মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে, ৪ হাজার ৩৯০টি অস্ত্র। ১ হাজার ৩৪৪টি অস্ত্র এখনো দুর্বৃত্তদের হাতে রয়েছে। কারাগার থেকে লুট হওয়া ৯৪টি অস্ত্রের মধ্যে এখনো উদ্ধার হয়নি ২৭টি অস্ত্র।

অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অস্ত্রগুলোই এখন টার্গেট কিলিং, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারে ব্যবহৃত হচ্ছে।

মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিওনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী ও অপরাধী চক্রের পুনরুত্থান এখনই থামানো না গেলে দেশ ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাবে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন ঘিরে অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে নানা কারণে। এর মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরে বিভক্তি তৈরি হলে অপরাধীরা সুযোগ নেয়। পুলিশের মাঠপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণহীনতা থাকায় তথ্য পেলেও অনেক সময় অভিযানে দেরি হয়। এছাড়া আন্ডারওয়ার্ল্ডের সক্রিয়তা বাড়ছে নির্বাচন ঘিরে। মাদক, চাঁদাবাজি, জমি ব্যবসা-সবখানেই নতুন গ্রুপের উত্থান ঘটেছে। লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধীদের হাতে হাতে ছড়িয়েছে। তারা বলছেন, এসব অস্ত্র উদ্ধার না হলে টার্গেট কিলিং কমবে না।

পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, নির্দিষ্ট কাউকে টার্গেট করে গুলি চালালে তা পৃথিবীর কোনো দেশেই প্রতিরোধ করা যায় না। তদন্ত করা যায়, কিন্তু আগাম প্রতিরোধ কঠিন। তবে টার্গেট কিলিং বন্ধ করতে হলে, ভাড়াটে কিলারদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বাড়াতে হবে। নিজেদের মধ্যে কোনো বিবাদ দেখা দিলে নিজেরাই বসে মীমাংসা করা উচিত। নতুবা টার্গেট কিলিং কমানো কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এইচএম শাহাদাত হোসাইন বলেন, নির্বাচনের আগে-পরে যাতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকে সেই লক্ষ্যে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। তারা নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচনের পরে কোনো ধরনের সহিংসতা যাতে না হয়, সেদিকে নজর রাখবেন।