ডিসি নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই মাঠ প্রশাসনের এই গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ নিয়ে কয়েক দফায় নানা অভিযোগ সামনে আসে। এর মধ্যে বেশকিছু গুরুতর অভিযোগ প্রশাসনসংশ্লিষ্টদের নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। এসব কারণে নিয়োগ দিয়ে প্রত্যাহার করার ঘটনাও ঘটেছে। ডিসি নিয়োগ নিয়ে এই যখন অবস্থা তখন ইউএনও পদায়ন নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অথচ নির্বাচন পরিচালনা করার যে সংস্কৃতি দেশে বিরাজমান সেখানে মাঠ প্রশাসনে পুলিশের পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ডিসি ছাড়াও তার টিমের এডিসি, ইউএনও এবং এসি ল্যান্ড।
এ অবস্থায় নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যদি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষপাতদুষ্ট থাকার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ থাকে তাহলে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা দুরূহ হবে। প্রশাসনের নানা রকম সূক্ষ্ম কারচুপি ও প্রভাব বিস্তারের কারণে ভোটকেন্দ্রে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা ঘটতে পারে। অথচ ডিসি হিসাবে সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সরাসরি তল্পিবাহক হওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। কেউ ছিলেন বিগত সরকারের প্রভাবশালী সচিবদের একান্ত সচিব (পিএস)। অর্থাৎ ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে। অনেকের নেই মাঠ প্রশাসনে কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা। এ নিয়ে অভিযোগ ওঠায় ইতোমধ্যে নিয়োগ দিয়ে ছয়জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন নিয়ে প্রশাসনে হযবরল অবস্থা চলছে বললেও ভুল বলা হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ যুগান্তরকে বলেন, ‘সর্বশেষ নিয়োগ দেওয়া ডিসিদের দিয়েই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করবে সরকার। আমরা আর রদবদলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি না। তবে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে তফশিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন চাইলে প্রয়োজনীয় রদবদল করতে পারবে। তখন প্রশাসনযন্ত্র থাকবে নির্বাচন কমিশনের আওতাধীন। কিন্তু এই মুহূর্তে আর পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করছি না।’
জানা গেছে, ১৩ নভেম্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলার ডিসি হিসাবে নিয়োগ পাওয়া বিসিএস ২৭তম ব্যাচের জনৈক কর্মকর্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে ২০০৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগে স্নাতক শেষ করেন। ২০০৮ সালে চাকরিতে যোগ দেওয়া এই কর্মকর্তা ২০১৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ১ বছর ১ মাস ৭ দিন সরাসরি মাঠ প্রশাসনের বাইরে ছিলেন। পরে ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের ২৯ মে পর্যন্ত ৫ বছর ১ মাস ১৮ দিন শিক্ষা ছুটিতে ছিলেন। কর্মজীবনে প্রায় ৬ বছরের বেশি সময় তিনি সরাসরি মাঠ প্রশাসনের বাইরে ছিলেন।
চট্টগ্রামের ডিসি হিসাবে নিয়োগ পাওয়া মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞাকে নিয়েও রয়েছে বেশ বিতর্ক। বিসিএস ২৫তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের ক্ষমতাধর চার সচিবের একান্ত সচিব (পিএস) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ে সাবেক সচিব অশোক মাধব, আব্দুস সামাদ, মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ও মোস্তফা কামালের পিএস হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতাধর এই চার সচিবের পিএস হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহার করার যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এরপরও তাকে রাজবাড়ী, নারায়ণগঞ্জ এবং সর্বশেষ চট্টগ্রামের ডিসি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০২ সালে ইংরেজি বিভাগে থার্ড ক্লাস পেয়ে স্নাতক পাশ করেন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ পাওয়া মো. রায়হান কবির। ২০০৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ইংরেজিতে সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন এই কর্মকর্তা। ২০১১ সালের আগস্টে ইকনোমিক ক্যাডারে যোগ দেওয়া এই কর্মকর্তা মাঠ প্রশাসনে কাজের উল্লেখযোগ্য কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই ডিসি হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন। তার এ নিয়োগ নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষের শেষ নেই।
নড়াইল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিসি হিসাবে পদায়ন করা হয়েছে ২৫ ব্যাচের কর্মকর্তা শারমিন আক্তার জাহানকে। উপসচিব পদে পদোন্নতির পরই তার নেতৃত্বে শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারে ফুল দিতে যান কয়েকজন আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কাজ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর মাজারকে সামনে রেখে শপথ নেওয়া এই কর্মকর্তাকে পরপর দুই জেলার ডিসি হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। নড়াইলে ডিসি হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে পাঁচজন ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তাকে মাঠ প্রশাসনে কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ডিসি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নেত্রকোনার ডিসি সাইফুর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মো. শাহাদত হোসেন মাসুদ, বাগেরহাট জেলার গোলাম মোহাম্মদ বাতেন, ময়মনসিংহের সাইফুর রহমান এবং মানিকগঞ্জের নাজমুন আরা সুলতানার নাম রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পূর্বে মাঠ প্রশাসনের অভিজ্ঞতা নেই এমন কর্মকর্তাদের ডিসি হিসাবে পদায়নের ঘটনা নজিরবিহীন। এ ধরনের নিয়োগের পেছনে বড় কোনো চক্র কাজ করতে পারে। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে কৌশলে এসব অদক্ষ কর্মকর্তাকে মাঠে পাঠানো হতে পারে। নির্বাচনকালীন ডিসি নিয়োগকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সরকারের উচিত ছিল অধিকতর যোগ্য কর্মকর্তা খুঁজে বের করা। তারা আরও বলছেন, ডিসি নিয়োগের এই বিতর্ক যেন থামছেই না। কয়েক দিন আগে দেখলাম, বিতর্কের জেরে বেশ কয়েকজন ডিসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু হতবাক হওয়ার মতো বিষয়ে হলো-যাদের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে, তারাও বিতর্কিত।
জানতে চাইলে সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যা নিয়ে কথা বলা মুশকিল। প্রশাসনকে এভাবে বিতর্কিত করা মোটেই ঠিক হয়নি। যাদের ডিসি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হলো তাদের যাচাই-বাছাই আরও নিখুঁত ও বিতর্কমুক্ত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু যা হয়েছে তা খুবই দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন, শেষ ভরসা হচ্ছে-উপরে যারা আছেন তারা যদি ঠিক থাকেন তাহলে সমস্যা হবে না। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, মাথা ঠিক থাকলে শরীর ঠিক থাকে। আর মাথা খারাপ হলে শরীর আর কাজ করে না। সুতরাং সরকার এবং প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে যারা আছেন, তারা ঠিক থাকলে সমস্যা হবে না।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসন যে পর্যায়ে গেছে তা এক যুগেও স্বাভাবিক করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, যাদের মাঠে কাজ করার প্রশাসনিক ও নির্বাচনের অভিজ্ঞতা নেই তাদের দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করানো যাবে না। তাদের যাচাই-বাছাই এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের এ দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, আগের সরকারের সময় যারা দলবাজ তাদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষদের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। আগের সরকারের সময় যারা ম্যাজিস্ট্রেট এবং ইউএনও ছিলেন তারাই এখন ডিসি হিসাবে পদায়িত হওয়ার কথা। প্রশ্ন হলো-তারা কি সবাই খারাপ? তাদের মধ্যে কি দক্ষ অফিসার নেই? অথচ যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই।
তারপরও বলব-মাঠ প্রশাসনে যারা কাজ করেন, তাদের কাছে সরকার কি চায় এবং কি ধরনের নির্বাচন চায় সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য, প্রভাবমুক্ত ও স্বচ্ছ নির্বাচন চায় তাহলে নির্বাচন সেই রকম হবে। মূলত সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে নির্বাচন কেমন হবে।
সাবেক একজন সচিব বলেন, আইন ও বিধি মোতাবেক কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর রাজনীতি সংশ্লিষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া নিয়োগের সময় মেধা ও যোগ্যতা ছাড়া কারও শিক্ষা জীবন ও পরিবারের রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিবেচনায় আনা ঠিক নয়। অথচ এমন প্রত্যাশা করা এখন স্বপ্নের মতো বিষয়। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো-এক শ্রেণির ক্যাডার কর্মকর্তারা এখন কর্মজীবনে রাজনীতি চর্চা বেশি করেন। প্রাইজ পোস্টিং এবং দ্রুত পদোন্নতি পেতে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে প্রশাসনে বেশির ভাগ কর্মকর্তা সরকারি দলের দাস হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন। এখানেই শেষ নয়, প্রভাবশালী আমলা থেকে কেউ কেউ রাতারাতি এমপি-মন্ত্রীও হয়ে যান। প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডার ছাড়াও প্রায় সব ক্যাডার, এমনিক সামরিক প্রশাসনেও একই রোগ বাসা বাঁধে। ফলে ফ্যাসিস্ট আমলের এসব ময়লা-আবর্জনা সহসা পরিষ্কার সহজ হবে না।