আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে এমনিতেই চ্যালেঞ্জের শেষ নেই। তার ওপর দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোট আয়োজনের বাধ্যবাধকতাকে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে নির্বাচন কমিশন। স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনও একই দিনে দুইটি নির্বাচন আয়োজনকে ‘চ্যালেঞ্জ’ বলে মন্তব্য করেছেন। যদিও সঠিক সময়ে নির্বাচন আয়োজনে কমিশন পুরোপুরি প্রস্তুত বলে প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন সিইসি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বহুবার ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে দেশে একটা ‘সেরা’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গত ১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণে তিনি ঘোষণা দেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই জুলাই সনদের ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করার পাশাপাশি গত শনিবার নির্বাচন কমিশনকে চিঠিও দিয়েছে সরকার। গণভোট আইন তৈরির প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে। এমনই একটি পরিস্থিতিতে শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন নির্বাচন কমিশনের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ।
যদিও প্রধান উপদেষ্টার সুরে সুর মিলিয়ে সিইসিও এর আগে বহুবার বলেছেন, ইতিহাসের ‘সেরা’ নির্বাচন আয়োজন করার প্রস্তুতি চলছে। কারণ নজিরবিহীন কলঙ্ক ও তামাশায় ভরপুর পর পর তিনটি জাতীয় নির্বাচন দেখে ত্যক্তবিরক্ত দেশবাসীও একটি ‘সেরা’ নির্বাচনের জন্য উন্মুুখ হয়ে অপেক্ষা করছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমিশন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মন্তব্য করে সিইসি বলেন, আমরা সেই মোতাবেক কাজ করছি। ভোটার তালিকা আপডেট থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রক্রিয়ার কাজ চলছে। আগামীতে যত চ্যালেঞ্জই আসুক, মোকাবিলা করে আমাদের প্রতিজ্ঞা আমরা রাখব। সঠিক সময়ে নির্বাচনের জন্য আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পলায়নের পর থেকেই দেশব্যাপী পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, লুণ্ঠিত কয়েক হাজার আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার না হওয়া, তথ্যাকথিত ‘মব’ ভীতির কারণে বিগত সরকারের সময় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হতে অনাগ্রহ, গণঅভুত্থানের শক্তিগুলোর মুখোমুখি অবস্থান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর বিভিন্ন মহলের ধারাবাহিক চাপের কারণে প্রত্যাশিত ‘সেরা’ নির্বাচন আয়োজন কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তার ওপর একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের আয়োজন এবং নির্বাচনে প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে গিয়ে নির্বাচন কমিশনের ওপর তার সাধ্যের অধিক বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কী-না খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মন্তব্য তাদের।
জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে মোট তিনবার গণভোট হয়েছে। প্রথমবার ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে। দ্বিতীয়বার ১৯৮৫ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে। সর্বশেষ ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। প্রতিবারই গণভোটের দিন অন্য কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। অন্যদিকে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এ পর্যন্ত ১২ বার। কখনোই জাতীয় নির্বাচনের দিন অন্য কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর দেশে চতুর্থবারের মতো আবার গণভোট হতে যাচ্ছে। এবারই প্রথম গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনের অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এবারই প্রথম প্রবাসীদের ভোটদানের সুযোগ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠেছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে।
একই দিনে দুটি নির্বাচন আয়োজনের চ্যালেঞ্জকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, সিইসি যে চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন সেটি তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ। নির্বাচনের প্রস্তুতি তো তারা নিচ্ছেন। তারাই জানের তারা কতটা প্রস্তুত। প্রস্তুতিতে ঘাটতি কোথায় আছে সেটিও তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে তিনি তো এও বলেছেন যে একই দিনে দুইটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা বদ্ধপরিকর। নির্বাচন কমিশনের সচিবও একই ধরনের প্রস্তুতির কথা বলছেন। আমরা চাই নির্বাচন সুষ্ঠু হোক, গ্রহণযোগ্য হোক। নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। নতুন করে ভিন্ন ভিন্ন দিনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় এখন নেই বলেও মন্তব্য করেন বদিউল আলম মজুমদার।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশের ৬৬৪টির মধ্যে ৪৬০ থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়। তখন ১১৪টি ফাঁড়িতেও লুটপাট চালায় দুর্বৃত্তরা। থানা ও ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে পিস্তল, রিভলভার, শটগানসহ ১১ ধরনের প্রায় ৬ হাজার অস্ত্র লুট করে হামলাকারীরা। লুট হওয়া ৪ হাজার ৩৮৩টি অস্ত্র ইতোমধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৩৬৬টি অস্ত্র উদ্ধারের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এ ছাড়া লুট হওয়া ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২টির মধ্যে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৪৫টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। স্বাভাবিক কারণেই নির্বাচনের সময় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা।
আগামী নির্বাচনের আয়োজনে চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রযুক্তি। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রয়োজন। নির্বাচন ঘিরে মানুষের আস্থা ফেরানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ মন্তব্য তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকাটা যেমন চ্যালেঞ্জ তেমনি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবক্ষেত্রে মানুষের আস্থা ফেরানোটাও বড় চ্যালেঞ্জ। মানুষকে কেন্দ্রমুখী করতে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনে আস্থা ফেরাতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশনের হুঁশ থাকা পর্যন্ত সকল কার্যক্রম একেবারেই সোজা থাকবে, বিধিবিধান বা আইনকানুন ছাড়া এটা বাঁকা হবে না। নানা কারণে বিগত সময়ের নির্বাচনগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল উল্লেখ করে সিইসি বলেন, এবারের নির্বাচন হবে বিশ্বমানের। বিগত নির্বাচনে যেসব মাঠ কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালনের সময় সমালোচিত হয়েছেন, আগামী নির্বাচনে তাদের পরিবর্তে বিকল্প চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। সেরা নির্বাচন আয়োজনে যারা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করা হবে বলেও ঘোষণা দেন সিইসি।