গত দুই দিনে চারবার ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন মানুষ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানুষের মাঝে আতঙ্ক দেখা দেয়। বার বার ভূমিকম্পের কারণে বিশেষ করে শিশুরা বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ভূমিকম্প আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে মানুষ নিজের ঘর ছেড়ে বাইরে এসে অবস্থান নেন। এমনকি রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় সারারাত অনেককে বাইরে কাটাতে হয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গত দুইদিনে বেশ কয়েকবার ভূমিকম্পের পর নতুন করে বড় ধরনের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ধারাবাহিকতা, দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ফাটল রেখার নড়াচড়া এবং বিশেষজ্ঞদের জরুরি সতর্কতা সব মিলিয়ে বড় ধরনের ভূমিকম্প নিয়ে উদ্বেগ আরো বেড়েছে। বাংলাদেশ এমন এক ভূ-টেকটোনিক অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে বড় কম্পন যেকোন সময় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত দুই দিনে চার দফা ভূমিকম্পের পর ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ছাত্রাবাসে বড় ধরনের ফাটল দেখা দেয়। জরাজীর্ণ ভবনটি ধসে পড়তে পারে এমন আশঙ্কায় শনিবার রাত থেকেই ছাত্রাবাস ছাড়িয়ে সড়কেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষার্থীরা। শনিবার রাতে শিক্ষার্থীরা হলটিতে অবস্থান করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সড়কে বিছানা-পট্টি নিয়ে অবস্থান নেন। ভূমিকম্পের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়। ভূমিকম্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলসহ কয়েকটি হলের কয়েকটি ভবনের পলেস্তারা খসে পড়। গত শনিবার সন্ধ্যায় হওয়া ভূমিকম্পের পর রাত ১২টার দিকে ভূমিকম্প আতঙ্কে হলকক্ষ ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে নেমে আসেন ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ তুলে বিক্ষোভও করেন তারা। ভূমিকম্পের পর দেখা যায় হলের বিভিন্ন দেয়ালে ফাটল তৈরি হয়েছে এবং ছাদের একাধিক জায়গার প্লাস্টার বড় আকারে খসে পড়েছে।
এদিকে, একদিনের ব্যবধানে পরপর চারবার ভূমিকম্প এবং উৎপত্তিস্থল নরসিংদী হওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে জেলাজুড়ে। তৃতীয় দফায় ভূমিকম্পের পর আতঙ্কে সারারাত জেগে ঘরের বাইরে অবস্থান নেয় সাধারণ মানুষ। ভূমিকম্পের পর স্থানীয় প্রশাসন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার শুরু করে। তবে রাত ১২টার পর আবার ভূমিকম্প হতে পারে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তায় ও নিরাপদ মনে করে খোলা জায়গায় অবস্থান নেন। নরসিংদী পৌর শহর ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় মানুষকে দলে দলে ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে অবস্থান করতে দেখা যায়। কেউ কলেজ মাঠে অবস্থান করেন আবার অনেকেই নিজ ভবনের নিচতলায় নেমে আসেন। স্কুল-কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এরকমও একটি গুজব ওঠে নরসিংদীতে। বিভিন্ন বাসা-বাড়ির লোকজন পাটি, মাদুর, বিছানাসহ বাসার বাহিরে এসে খোলা মাঠে অবস্থান করেন।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ঢাকা শহরের ঘনবসতি ও অনিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণ বড় কোনও ভূমিকম্প হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ করে তুলবে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বহু ভবন নির্মাণ বিধিমালা মেনে নির্মাণ করা হয়নি। পাশাপাশি অনেক পুরোনো ভবনের ওপর নতুন করে কয়েক তলা তৈরি করে বহুতল ভবন করা হয়েছে। সেগুলো রাজউক কখনো তদারকি করেনি। যার ফলে নগরীজুড়ে ভয়াবহ শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বুয়েট), রাজউক এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে যে, ভারতীয় প্লেট প্রতিনিয়ত পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছে এবং সেই চাপ মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ওপর জমা হচ্ছে। ভারত, ইউরেশিয়া ও বার্মা, মোট তিনটি দৈত্যাকৃতির টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশ। প্লেটগুলো এখন আটকানো অবস্থা থেকে খুলে যাচ্ছে। ফলে যেকোনো সময় আরো উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে পড়তে পারে বাংলাদেশ।এ অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা এ চাপ হঠাৎ মুক্তি পেলে বড় ধরনের ভূমিকম্পে গড়াতে পারে বিপর্যয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রফেসর মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, গত দুদিনে দেশে অন্তত চারবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। আমাদের দেশে কোন প্রিপারেশন নাই। পুরো ঢাকায় ভবন নির্মাণ হয়ে অকেজো হয়ে আছে। বাসা বাড়িগুলোর একেবারে অবস্থা খারাপ। যে ভবনগুলোর কোন অনুমোদন নেই। বড় ভূমিকম্প হলে পুরো ঢাকার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। রাজউকের কোনো মাথা ব্যথা নেই। ভবন নির্মাণ করার সময় যে রাজউক তদারকি করবে এমন অবস্থায় তারা নেই। তাদের দক্ষ জনবল নেই যে তারা ভবনগুলো তদারকি করবে। মূলত রাজউকের অবহেলা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অসচেতনতার অভাবে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে।