মাদক বিক্রি, আধিপত্য বিস্তার, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, পূর্বশত্রুতার জের, রাজনৈতিক ঘটনা, জায়গাজমি নিয়ে বিরোধসহ পারিবারিক কলহে চট্টগ্রাম বিভাগে একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে। চট্টগ্রাম মহানগরীসহ চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলায় গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্ত ১৪ মাসে ৭৮৫টি হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীতেই হয়েছে ৮২টি হত্যা মামলা। একই সময়ে চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন থানায় ৭০৩টি হত্যা মামলা হয়েছে।
এই হিসাবে গড়ে প্রতি মাসে হত্যা মামলা হয়েছে ৫৬টি। পুলিশ সদর দপ্তর, পুলিশের ওয়েবসাইট ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে হত্যার শিকার হন ছাত্রদলকর্মী সাজ্জাদ হোসেন। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের রাউজান পৌরসভার রশিদারপাড়া এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয় যুবদলকর্মী মুহাম্মদ আলমগীরকে। গত ২৩ অক্টোবর চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জায়গাজমির বিরোধে রিপু আক্তার নামের এক নারীকে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়। এরপর অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ২১ অক্টোবর চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সহপাঠীদের ছুরিকাঘাতে মো. তানভীর নামের এক স্কুলছাত্র নিহত হয়েছে।
স্কুলে ঝগড়ার জেরে তাকে হত্যা করা হয়। ১ অক্টোবর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে গলা কেটে হাবিবুর রহমান নামের এক অটোরিকশাচালককে হত্যা করা হয়। এই সময় তাঁর অটোরিকশা নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে স্ত্রীর সঙ্গে অন্য এক যুবকের সম্পর্কের জেরে আকিব হোসেন নামের একজনকে ছুরিকাঘাতে হত্য করা হয়।
এরপর পুলিশ সাইফুল নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে। গত ২৫ জুলাই চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার আরাকান রোডসংলগ্ন ৫ নম্বর ব্রিজ এলাকায় মাদক ব্যবসার দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারের জেরে মো. মহিউদ্দিন নামের একজনকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
আবার চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় এই ১৪ মাসে ১৭টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, বালু উত্তোলন, ব্যাবসায়িক দ্বন্দ্ব এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এসব হত্যার ঘটনা ঘটছে। শুধু রাউজান নয়, পুরো চট্টগ্রাম বিভাগেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। হত্যার পর লাশ ফেলে রাখা হয় খালে, নালায়। চট্টগ্রামে একের পর এক হত্যার ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে।
এই ১৪ মাসে ৭৮৫টি হত্যা মামলার মধ্যে চলতি বছর অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলায় মামলা হয়েছে ৬৪টি। সেপ্টেম্বর মাসে মামলা হয়েছে ৬২টি, আগস্ট মাসে ৪৫টি, জুলাই মাসে ৫৫টি, জুনে ৬০টি, মে মাসে ৬১টি, এপ্রিলে ৭৭টি, মার্চে ৭২টি, ফেব্রুয়ারিতে ৫৩টি ও জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে ৫৪টি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরে মামলা হয়েছে ৬১টি। আর চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায় মামলা হয়েছে ৫৪২টি। চলতি বছর এপ্রিলে সর্বাধিক ৭৭টি হত্যা মামলা হয়েছে। কয়েকটি হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে বিভিন্ন হত্যার ঘটনায় ব্যবহৃত হচ্ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যাসহ টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনাও ঘটছে।
অন্যদিকে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে ৫৪টি, অক্টোবর মাসে ৫৮টি, নভেম্বর মাসে ৩৪টি এবং ডিসেম্বর মাসে ৩৬টি হত্যার মামলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের জনসংযোগ কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার আমিনুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে কোনো হত্যার মামলা হলে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়। আর যেসব মামলার আসামি গ্রেপ্তার হয়নি, তাদের গ্রেপ্তারে থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ তৎপর আছে।’
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয়ের পুলিশ সুপার (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) মো. আকরামুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোনো ঘটনা ঘটলে তদন্ত করে দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া কমিউনিটি, বিট পুলিশ ও থানা পুলিশ সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছে। তুচ্ছ ঘটনায়ও হত্যাকাণ্ড ঘটে যায়। এতে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই অপরাধে না জড়াতে আমরা সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছি। পাশাপাশি কেউ অপরাধ করলে দ্রুত সময়ের মধ্যে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।’
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রামের সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে এসব ঘটনা ঘটছে। গত বছর ৫ আগস্টের আগে যেসব অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে ছিল, সেগুলো উদ্ধার করা হয়নি। থানা লুটের অনেক অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। অস্ত্র হাতে থাকলে ব্যবহারের একটা প্রবণতা থাকে। ফলে একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটছে। দেখা গেছে, গত বছর ৫ আগস্টের পর অনেক সন্ত্রাসী জামিন নিয়ে জেল থেকে বের হয়ে এসেছে। তারাও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আশা করব নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, তখন অস্ত্র উদ্ধার, যৌথ অভিযান জোরদার করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে। নির্বাচনে যে দল জয়লাভ করবে, তাদেরও প্রধান দায়িত্ব হবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা।’