Image description
আবু সাঈদ, চানখাঁরপুল ও আশুলিয়ায় হত্যা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে রায়ের পর আরও তিন মামলার বিচার শেষ পর্যায়ে এসেছে। এর মধ্যে জুলাই আন্দোলনে রাজধানীর চানখাঁরপুলে ৬ জনকে গুলি করে হত্যা মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দি শেষে এখন জেরার জন্য দিন ধার্য আছে। আশুলিয়ায় ৬ জনকে হত্যার পর লাশ পোড়ানো এবং রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণও শেষের পথে। এরই মধ্যে আশুলিয়ায় ছয় লাশ পুড়িয়ে হত্যার মামলার রাজসাক্ষী এসআই শেখ আবজালুল হকের জেরা শেষ হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২৬ নভেম্বর দিন ধার্য রয়েছে।

রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা মামলায় ১৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য সম্পন্ন হয়েছে। আজ পরবর্তী সাক্ষীর জন্য দিন ধার্য আছে। এসব মামলায় সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান (পলাতক), আশুলিয়ার সাবেক সংসদ-সদস্য (পলাতক) সাইফুল ইসলামসহ ৫৪ আসামির বিচার চলছে। যাদের মধ্যে বেশির ভাগই পুলিশের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও সদস্য। প্রসিকিউশন জানিয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে এই তিনটি মামলার বিচার ট্রাইব্যুনাল শেষ করতে পারবেন বলে তারা বিশ্বাস করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব মামলার বিচার শুনানি চলছে।

বিগত ১৫ বছরে গুম খুন ও জুলাই আন্দোলনের মানবতাবিরোধী অপরাধে এ পর্যন্ত ১০টি মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানের আটটি এবং গুম-খুন নির্যাতনের দুটি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী, সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তা, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শকসহ ৯৪ জনকে আসামি করা হয়। ফরমাল চার্জ দাখিল হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার একটি রায় ঘোষণার পর বাকি মামলাগুলোর বিচার শেষ করতে কাজ করছে প্রসিকিউশন। জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ট্রাইব্যুনাল এই তিনটি মামলার বিচার শেষ করতে পারবে। এ ব্যপারে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক আইনি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি, ট্রাইব্যুনাল ন্যায়বিচার করবেন।

প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ বলেন, দুটি ট্রাইব্যুনালে তিন মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ পর্যায়ে এসেছে। আশা করছি, ফেব্রুয়ারির আগেই ট্রাইব্যুনাল এই তিনটি মামলার বিচার শেষ করতে পারবেন। তবে সবকিছু নির্ভর করছে পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর। এছাড়া রামপুরা হত্যা মামলার সাক্ষ্য শুনানিও শেষ পর্যায়ে এসেছে।

প্রসিকিউশন থেকে জানা যায়, এখন পর্যন্ত জুলাই-আগস্টের ঘটনা ও গুম-নির্যাতনের ৪৫০টি অভিযোগ জমা পড়ে ট্রাইব্যুনালে। এসব তথ্য প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের পর ‘মিস কেস’ বা বিবিধ মামলা হয়েছে ৩০টি। যেসব মিস কেস তদন্তাধীন আছে, তার মধ্যে একটিতে আসামির তালিকায় আছেন ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, জুনাইদ আহমেদ পলকসহ ৪৫ জন। প্রসিকিউশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হকের বিষয়ে তদন্ত শেষ পর্যায়ে। খুব শিগ্গিরই আরও বেশ কয়েকটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে তদন্ত সংস্থা জানিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো ঘটনায় বা অভিযোগে প্রথমে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় বা তদন্ত সংস্থায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করতে হয়। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে তা ‘মিস কেস’ বা বিবিধ মামলা হিসাবে ট্রাইব্যুনালে নথিভুক্ত হয়। এরপর তদন্ত সংস্থা ওই অভিযোগের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। চিফ প্রসিকিউটর সেই তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেন এবং আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আকারে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন।

চাঁনখারপুলে ছয় হত্যা মামলা : জুলাই আন্দোলনে রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনের বিরুদ্ধে মূল তদন্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলামের তদন্ত শেষ হয়েছে। জেরার জন্য আজ দিন ধার্য রয়েছে। বিচার চলছে চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

এ মামলার গ্রেফতার চার আসামি হলেন-শাহবাগ থানার সাবেক ওসি (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। পলাতক আসামি হলেন-সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম এবং রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল। ১৪ জুলাই চানখাঁরপুলের মামলাটির পলাতক চার আসামিসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল এলাকায় শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি চালায় পুলিশ। এতে বহু হতাহতের পাশাপাশি শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া শাহরিক নিহত হন।

আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানোর মামলা : গত বছরের ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় হত্যার পর ছয় লাশ পোড়ানোর মামলায় সাবেক সংসদ-সদস্য সাইফুল ইসলামসহ ১৬ জন আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া রাজসাক্ষী এসআই শেখ আবজালুল হকের জেরা শেষ হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২৬ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে এই মামলার বিচার চলছে। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।

ঘটনার বিবরণ দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট বেলা ৩টার দিকে আশুলিয়া থানার সামনে পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর বাইরে আরও একজন গুলিতে গুরুতর আহত হন। একজনকে জীবিত এবং পাঁচজনকে মৃত অবস্থায় প্রথমে একটি ভ্যানে তোলা হয়। সেখান থেকে পুলিশের একটি গাড়িতে তোলে পুলিশ। পুলিশের গাড়িতে এই ছয়জনকে (যার মধ্যে একজন জীবিত) আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় পুলিশ। এ সময় শহীদ হন সাজ্জাদ হোসেন (সজল), আস সাবুর, তানজীল মাহমুদ সুজয়, বায়েজিদ বুসতামি, আবুল হোসেন ও একজন অজ্ঞাতপরিচয়।

এ মামলায় আসামি ১৬ জন। তাদের মধ্যে ৮ আসামি গ্রেফতার আছেন। তারা হলেন সাভার সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শহিদুল ইসলাম, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল মালেক, আরাফাত উদ্দীন, কামরুল হাসান, শেখ আবজালুল হক ও সাবেক কনস্টেবল মুকুল চোকদার। সাবেক সংসদ-সদস্য মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামসহ এই মামলার আট আসামি পলাতক।

আবু সাঈদ হত্যা : গত বছর সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন ১৬ জুলাই দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে গুলিবিদ্ধ হন আবু সাঈদ। ২৫ বছর বয়সি আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। এ মামলায় ১৮ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ এসে জবানবন্দি দেন সহযোদ্ধা রওনক। ১৯ নম্বর সাক্ষী হিসাবে সাক্ষ্য দেন তিনি। জুন চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে আবু সাঈদ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সেখানে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলামসহ ৩০ জনকে এই মামলায় আসামি করা হয়।

তাদের মধ্যে গ্রেফতার আছেন ছয়জন। তারা হলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার রাফিউল হাসান রাসেল, রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক সাবেক কর্মচারী মো. আনোয়ার পারভেজ, পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় এবং নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ইমরান চৌধুরী ওরফে আকাশ।

অপরদিকে জুলাই-আগস্টে রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করাসহ দুজনকে হত্যার ঘটনায় করা মামলায়ও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। এ মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসাবে সাক্ষ্য দিয়েছেন গুলিবিদ্ধ আমির হোসেন। সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ এ মামলায় আসামি পাঁচজন। এর মধ্যে একমাত্র গ্রেফতার আসামি রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার।

ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর সহিদুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার পালোয়ান, মামুনুর রশীদ ও বিএম সুলতান মাহমুদসহ অন্যরা।