Image description
ক্লান্ত ক্রুর হাতে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী উড়োজাহাজ । পাইলটদের জীবন নিয়ে বেবিচকের অবহেলা । অতিরিক্ত ফ্লাইংয়ের কারণে ৬ পাইলটের হার্ট অ্যাটাক । ফাইলবন্দি সেফটি রিপোর্ট, টনক নড়ছে না কর্তৃপক্ষের ।

রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ফ্লাইট সেফটি নেই ক্রুদের। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) খামখেয়ালির কারণে তাদের অতিরিক্ত সময় আকাশে উড্ডয়ন করতে হচ্ছে। এতে ককপিটে তাদের জীবনের ওপর বাড়ছে ঝুঁকি। এরই মধ্যে অতিরিক্ত ফ্লাইংয়ের কারণে ৬ জন পাইলট হার্ট অ্যাটাক করেছেন। অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফ্লাইট ডিউটি টাইম লিমিটেশন (এফডিটিএল) বিধি লঙ্ঘন করে পাইলটদের অতিরিক্ত সময় উড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। ‘ফ্লাইং ডেঞ্জার’ বিমানের পাইলটদের ডিউটি সংক্রান্ত শারীরিক ও মানসিক চাপের কারণে যাত্রীর নিরাপত্তাও হুমকির মুখে। নীতিবহির্ভূত ছাড় ও বিমানের চাপের কারণে নিয়মিত চলছে এমন ঘটনা। লঙ্ঘিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) নীতিমালাও। পাইলটদের জীবন ঝুঁকিসংক্রান্ত অভিযোগগুলোও ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে। অডিটের সময়ও তা এড়িয়ে যাওয়া হয়। যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আকাশপথ ব্যবস্থাপনায় পাইলট ও যাত্রীদের ঝুঁকি বিয়য়ে গুরুতর তথ্য।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, অতিরিক্ত উড্ডয়নের চাপ পাইলটদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। পাইলটদের জন্য ডেকে আনছে সরাসরি শারীরিক বিপর্যয়। গত তিন বছরে ৬ জন পাইলট হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ক্যাপ্টেন সৈয়দ বজলুর রহমান, ক্যাপ্টেন মুকাসসিত হোসাইন, ক্যাপ্টেন আনিসুর রহমান, ক্যাপ্টেন জয়নাল মিয়া ও ক্যাপ্টেন এএম মাকসুদ আহমেদ। এছাড়া অন্তত দুজন পাইলট মাঝ আকাশে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কো-পাইলটদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ও দক্ষতায় সে যাত্রায় বড় দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়েছিল।

গত বছরের ১৫ মার্চ ক্যাপ্টেন মাকসুদুল আলম দোহা অভিমুখী বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৭৭ নিয়ে উড্ডয়ন করেন। ভারতের নাগপুরে পৌঁছানোর পর তিনি পিঠের তীব্র ব্যথায় কাতরাতে থাকেন। পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকায় মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে উড়োজাহাজটি ৪১৯ জন যাত্রীসহ ঢাকায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়। অতিরিক্ত উড্ডয়নজনিত মেরুদণ্ডের ব্যথায় কয়েকজন পাইলটকে ইতোমধ্যে অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করতে হয়েছে। এছাড়াও মাঝ আকাশে অসুস্থ হয়ে মারা যান ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইয়ুম। ওমানের মাস্কাট থেকে শতাধিক যাত্রী নিয়ে ঢাকায় আসার পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বিমানটিকে ভারতের নাগপুরের ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করান কো-পাইলট। গুরুতর অসুস্থ ক্যাপ্টেন কাইয়ুমকে ভর্তি করানো হয় সেখানকার কিংসওয়ে হাসপাতালে। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) কোমায় থেকে মারা যান।

এ ধরনের শারীরিক সমস্যা, অস্বাভাবিক ক্লান্তি ও ঝুঁকি নিয়ে বিমানের সেফটি বিভাগে জমা আছে ৫০০টিরও বেশি সেফটি রিপোর্ট। কিন্তু বিস্ময়করভাবে এ বিপুলসংখ্যক রিপোর্টের একটিরও কোনো তদন্ত হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিনিয়র ক্যাপ্টেন যুগান্তরকে বলেন, ক্লান্তিজনিত কারণেই বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এতগুলো সেফটি রিপোর্ট জমা পড়লেও বেবিচক কেন চোখ বন্ধ করে রেখেছে। সেফটি রুলস না মানলে বিপর্যয় এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

সূত্রমতে, নীতিমালা (সর্বোচ্চ ১ হাজার ঘণ্টা) উপেক্ষা করে বিমানের পাইলটদের বছরে ১২০০ ঘণ্টা পর্যন্ত ফ্লাইট পরিচালনায় বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি অনেক ক্রু পরপর ১২ মাসে ১৪০০ ঘণ্টারও বেশি সময় উড়েছেন, যা সরাসরি নিরাপত্তা নির্দেশনা লঙ্ঘন।

তথ্যানুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, ২০২২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে এ অনিয়ম চলছে। বেবিচকের একাধিক প্রভাবশালী কর্মকর্তা নিয়ম ভেঙে বিমানের পাইলটদের অতিরিক্ত উড্ডয়ন অনুমোদন দিচ্ছেন। বিশেষ সুবিধা দিতে বার্ষিক উড্ডয়ন সময়ের সীমা ১ হাজার থেকে ১২শ ঘণ্টায় বাড়িয়ে অনুমোদন দেওয়ার একটি চিঠি এসেছে যুগান্তরের হাতে। চলতি বছরের এপ্রিলে এক বিশেষ ছাড়পত্রের মাধ্যমে বিমান সংস্থাটিকে সাময়িকভাবে বিদ্যমান নিয়মের চেয়ে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ ফ্লাইট টাইম ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়; যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও নিরাপত্তা প্রটোকলের পরিপন্থি। এ ছাড়ের ক্ষেত্রে ৯০ দিনের মধ্যে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের শর্ত দেওয়া হলেও তার কোনো সমাধান আসেনি।

বিশ্বব্যাপী প্রচলিত নিরাপত্তাবিধি অনুযায়ী, অতিরিক্ত উড্ডয়ন পাইলটদের শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি বাড়ায়; ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। তবুও বিমানের অনুরোধে বেবিচকের কিছু কর্মকর্তা এ অনিয়মিত অনুমোদন অব্যাহত রেখেছেন। এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আমরা নিয়মিতভাবে অতিরিক্ত ফ্লাইটে বাধ্য হচ্ছি। কোনো কোনো মাসে ১২০ ঘণ্টা পর্যন্ত উড়তে হয়। ক্লান্তি বা বিশ্রাম না পেলে তা সেফটি ঝুঁকি তৈরি করে; কিন্তু আপত্তি তুললেই হয়রানির মুখে পড়তে হয়। প্রায়ই পাইলট ও ক্রুরা অসুস্থ হয়ে পড়েন।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিমান পরিচালনার সনদ (এওসি) নবায়ন অডিটের সময় দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃতভাবে ফ্লাইট ডিউটি টাইম লঙ্ঘনের বিষয়টি উল্লেখ করেন না। ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে তারা নিরাপত্তা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ এ তথ্য আড়াল করে, যা সিভিল এভিয়েশন নীতিমালা অনুযায়ী গুরুতর অনিয়ম হিসাবে গণ্য হয়। যদিও ইএএসএ-এর মূলনীতিতে উড্ডয়ন সময়সীমা কঠোরভাবে নির্ধারিত। বেবিচক প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সেই নিরাপত্তা মানদণ্ড উপেক্ষা করে অতিরিক্ত সময় উড্ডয়নকে বৈধতা দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক নিয়ম ও নিরাপত্তাচর্চার সঙ্গে সরাসরি বিপরীতধর্মী। ইএএসএ উড্ডয়ন সময়সীমা নীতি (ওআরও-২১০) অনুযায়ী, মাসিক উড্ডয়ন সময়সীমা সর্বোচ্চ ১০০ ঘণ্টা এবং বার্ষিক সীমা ৯০০ ঘণ্টা নির্ধারিত। কিন্তু বেবিচক সেটি পরিবর্তন করে মাসিক ১২০ ঘণ্টা পর্যন্ত বাড়িয়েছে এবং ক্যালেন্ডার বছরের ৯০০ ঘণ্টার সীমা সম্পূর্ণ বাতিল করেছে। একইভাবে কেবিন ক্রুদের টানা ১২ মাসে উড্ডয়ন সময়সীমা ১ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১১০০ ঘণ্টা করেছে।

অথচ আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) ডক ৯৯৬৬-তে স্পষ্ট করা আছে। এতে বলা হয়, যে কোনো দেশের বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে ক্লান্তিঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (এফআরএমএস) কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না পারলে বাধ্যতামূলকভাবে প্রথাগত নির্দেশনাভিত্তিক পদ্ধতি (প্রেসক্রিপটিভ মেথড) অনুসরণ করতে হবে। বেবিচক ইএএসএ-এর নীতিমালা অনুসরণ করলেও বিমান চলাচল আদেশ (এএনও ৬-১) অনুযায়ী কোনো বাণিজ্যিক পাইলট টানা ১২ মাসে ১০০০ ঘণ্টার বেশি উড্ডয়ন করতে পারবেন না। কিন্তু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে বাস্তবে এ নিয়মের প্রকাশ্য লঙ্ঘনের অনুমোদন দেয় বেবিচক। উড্ডয়ন লগ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বহু পাইলট ও কেবিন ক্রু বছরে ১২শ থেকে ১৪শ ঘণ্টা উড্ডয়ন করেছেন, যা আইনি সীমার তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। একদিকে আইকাওর আন্তর্জাতিক বিধি অমান্য করে উড্ডয়ন সময় বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে বেবিচকের নিজস্ব নীতিমালাও ধারাবাহিকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ দ্বৈত অনিয়মের ফলে বিমান নিরাপত্তা সরাসরি ঝুঁকির মুখে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ফ্লাইট টাইম অনেক কম। ভারতে বছরে সর্বোচ্চ ১০০০ ঘণ্টা। ডিউটি টাইম ১৮০০ ঘণ্টা। শ্রীলংকায় বছরে ৯০০ ঘণ্টার ফ্লাইট সীমা এবং মাসে ১০০ ঘণ্টার বেশি উড্ডয়ন করতে পারে না। পাকিস্তানে এক মাসে ১০০ ঘণ্টা এবং বছরে ৯৫০ ঘণ্টা। তুরস্কে ২৮ দিনে ১০০ ঘণ্টা এবং বছরে সর্বোচ্চ ৯০০ ঘণ্টার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এমন অনিয়ম চলতে থাকলে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক উইং কমান্ডার এটিএম নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসাবে তাদের কাজ হলো নিরাপত্তা মানদণ্ড নিশ্চিত করা। যদি কর্মকর্তারা দুর্নীতির বিনিময়ে এ ধরনের ছাড় দেন, তবে যে কোনো সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এতে আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম ক্ষুণ্ন হবে বাংলাদেশের মান। সেফটি কনসার্নও জারি হতে পারে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন) ক্যাপ্টেন একেএম আমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, হজ মৌসুমে কিছু ব্যতিক্রম হয়েছিল। তবে এখন আর এমনটি হচ্ছে না। আমরা বেবিচকের নির্দেশনা অনুযায়ীই কাজ করি। নিয়ম লঙ্ঘন হয়েছে কি না, এ বিষয়ে বেবিচকই স্পষ্ট করে বলতে পারবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। নতুন দায়িত্বে আসায় আগের অনিয়ম সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত নন বলেও জানান। তিনি আরও বলেন, আইনের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অভিযোগের বিষয়ে বেবিচকের এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা যখনই আমাদের নজরে এসেছে, আমরা অডিটে যুক্ত পরিদর্শককে শোকজ করেছি। নীতিমালার ব্যত্যয়ের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বলতে হবে। তবে তিনি নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।