ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরই মধ্যে ৪৮টি দলের মতামত নিয়েছে সংস্থাটি। চারদিনব্যাপী এই সংলাপে দলগুলোর পক্ষ থেকে আসা আলোচনায় নির্বাচনকেন্দ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি উঠে এসেছে। সেই সঙ্গে আলোচনায় ইসি ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতার ওপর জোর দিয়েছে দলগুলো। গত ১৩ই নভেম্বর থেকে ১৯শে নভেম্বর পর্যন্ত সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় আসন্ন নির্বাচনে দলগুলোর চাওয়া অনুযায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার বিষয়ে সিইসি এএমএম নাসিরউদ্দিনও আশ্বস্ত করেন।
সংলাপের প্রথম দিনেই অংশ নেয়া একাধিক দল ভোটের সময় নিরাপত্তার সংকটের কথা জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডিয়াম সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী (বীরবিক্রম) বলেন, আমরা মনে করি, এখনো যথেষ্ট নিরাপত্তা সংকট বিরাজ করছে। ফলে ভোটারদের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। তাই তফসিল ঘোষণার আগেই একটি নিরাপত্তা অভিযান পরিচালনা করা উচিত। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদেক হক্কানী বলেন, অতীতের নির্বাচনে কালোটাকা ও হুমকি-ধমকির মাধ্যমে ভোটারকে প্রভাবিত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন যদি এসব বিষয়ে কঠোর নজর রাখে, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। বাংলাদেশ মুসলিম লীগের উপদেষ্টা জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবু বলেন, আমরা সময়মতো নির্বাচন চাই এবং নির্বাচনের পরিবেশ উন্নত করতে ইসিকে উদ্যোগী হতে হবে। ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান শেখ সালাউদ্দিন সালু বলেন, ‘জামানতের টাকা ৫০ হাজার করা হয়েছে, যা বড় দলগুলোর জন্য সহজ হলেও ছোট দলের পক্ষে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কংগ্রেসের চেয়ারম্যান এডভোকেট কাজী রেজাউল হোসেন বলেন, বড় দলগুলো নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এখনো মহড়া চলছে। ইসি যদি এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারে, তাহলে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
গত ১৬ই নভেম্বর সংলাপে অংশ নেয়া একাধিক দল নিরাপত্তার পাশাপাশি ইসি ও প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকার উপর জোর দিয়েছে। দলগুলোর নেতারা জানান, বিগত দিনের নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন একযোগে একটি দলের পক্ষ হয়ে কাজ করেছে। যা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করেছে। জনগণের সঙ্গে নির্বাচন নামে প্রহসনমূলক আচরণ করা হয়েছে। বর্তমান ইসিকে তাই নিরপেক্ষ থেকে ত্রয়োদশ নির্বাচন পরিচালনার পরামর্শও দিয়েছেন নেতারা।
গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, আপনাদের মেয়াদে সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচন-দুটিতেই নিরপেক্ষতার ছাপ রাখতে হবে। সেটা জনগণ যেন দেখতে পায়। গণভোটের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, প্যাকেজে সবকিছুকেই একসঙ্গে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’তে নেয়া হচ্ছে। এটি অকার্যকর হওয়ার ঝুঁকি আছে। গণভোট যেন হাস্যরসে পরিণত না হয়, সে জন্য আপনাদের শক্ত থাকতে হবে।
গণফ্রন্টের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মো. আকমল হোসেন বলেন, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের নৈতিক ভিত্তি। আমরা এই প্রথম ভিত্তিটাই শক্তিশালী করতে পারিনি। খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, বিগত তিন নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। মানুষ এবার ভোট দিতে মুখিয়ে আছে।
প্রচারণার ক্ষেত্রে ছোট ও নতুন দলগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে কয়েকটি বিধির বাস্তবসম্মত পরিবর্তনের দাবি জানান গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, প্রতীক অবশ্যই স্পষ্টরূপে বড় আকারে ছাপতে হবে, বিশেষত নতুন দলগুলোর জন্য। জোট গঠন করে কোনো দল জোটগত প্রতীকে নির্বাচন করতে চাইলে, সেই সুযোগ রাখা দরকার। এ ছাড়া গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচনের জন্য আলাদা বুথ ও গণনা পদ্ধতি দরকার এবং কেন্দ্রে পুলিশ, আনসার ও ব্যাকআপে সেনা সদস্যের নির্দিষ্ট সংখ্যা জনসম্মুখে জানানো দরকার। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনের পরিপূর্ণ ভূমিকা নেয়ার আহ্বান জানিয়ে এ জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম মহাসচিব মোমিনুল আমিন বলেন, যে ক্ষমতায় সবকিছু থাকবে সিইসি’র। তার ডিরেকশন, প্রজ্ঞায়, তার ক্ষমতায় একটা গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর ইরান বলেন, নির্বাচন কমিশনকে আমরা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে একটা জায়গায় দেখতে চাই। সুন্দর নির্বাচন চাই, একটা ভোট উৎসব চাই।
নিরাপত্তা ও নিরপেক্ষতার স্বার্থে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। দলটি মনে করছে, ইসি’র পক্ষ থেকে যদি রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া যায় তাহলে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া সংস্থাটির নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ ছাড়া জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।
১৯শে নভেম্বর সংলাপে অংশ নিয়ে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চারটি বোতাম আছে। একটি হচ্ছে ডিসি, একটি হচ্ছে এসপি, একটি হচ্ছে ইউএনও, আরেকটি হচ্ছে ওসি। এ চারটি বোতাম টেপা হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে, এরপর ৩০০ আসনে নির্বাচনের ফলাফল বের হয়ে আসে। এ পদ্ধতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তিনি এখানে ইসিকে শক্ত ভূমিকা নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তারা ইসিকে সব সহায়তা করবেন। কিন্তু ইসিকে শক্ত থাকতে হবে। সরকারের কাছে ইসি নতজানু থাকলে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রশ্নে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের লটারির মাধ্যমে বদলির পরামর্শ দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, প্রশাসনে নিরপেক্ষতায় আস্থা রাখার উপায় হলো লটারির মাধ্যমে ট্রান্সফার হওয়া। যার যেখানে তকদিরে আছে। প্রধান উপদেষ্টাকেও বলেছি, এরকম করলে প্রশ্ন থাকবে না। উনার বক্তব্যে বোঝা গেল- কোনোভাবে কোনো জায়গা থেকে শুরু করেছে। কেউ জানছেন কি, জানছেন না- কিছুটা অস্পষ্ট কথা উনার থেকে বোঝা যায়। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন সুষ্ঠু করার ও আস্থার জায়গা বলে উল্লেখ করেন মিয়া গোলাম পরওয়ার।
চারদিনের সংলাপে সিইসি এ এম এম নাসিরউদ্দিন বরাবরই রাজনৈতিক দলগুলোকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে আমাদের যে প্রতিশ্রুতি, সেটিতে আমরা অটল। তবে রাজনৈতিক দলগুলোকে সহযোগিতা করতে হবে।
এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা উৎসবমুখর নির্বাচনের কথা বলেন। আপনারা (রাজনৈতিক নেতারা) নির্বাচনের মূল প্লেয়ার। আপনাদের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। আপনাদের সহযোগিতা নিয়ে এগোতে চাই। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতিতে অটল রয়েছি। আমরা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর। নিরপেক্ষ, সুন্দরভাবে করতে গেলে আপনাদের সহযোগিতা লাগবে। দল, ভোটার সবাইকে নিয়েই নির্বাচন করতে হবে।