Image description

হঠাৎ করেই উত্তপ্ত আন্ডারওয়ার্ল্ড। লাশের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বাড়ছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্য গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, নির্মাণাধীন ও  ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি বেড়েছে। দেশে ও বিদেশে অবস্থান করে কলকাঠি নাড়ছে দেশের অপরাধ জগতের গডফাদাররা। চলছে এলাকা নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ঝরছে প্রাণ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আন্ডারওয়ার্ল্ডের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় নানা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ঘটনায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের সরাসরি কানেকশন মিলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তেও সত্যতা মিলেছে। প্রকাশ্য সন্ত্রাসীরা তৎপরতা চালালেও শুধুমাত্র কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেই পুলিশি তৎপরতা বাড়ে। অন্যদিকে সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া আচরণ ও প্রাণের ভয়ে অনেক ভুক্তভোগী মুখ খুলতে চান না। এমনকি তারা থানায় অভিযোগ ও পুলিশকে বিষয়টি জানান না। পাশাপাশি দাগি ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিনে মুক্তি পাবার পর তাদের নজরদারিতে রাখা হয় না। অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসীর অবস্থানও জানে না পুলিশ। এতে করে এসব দাগি অপরাধীরা বেপরোয়া তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। 

গত ১১ই নভেম্বর পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সন্ত্রাসী তারেক সাইদ মামুনকে। আদালতপাড়ায় মামুনকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ায় বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। এরপর আন্ডারওয়ার্ল্ডের উত্তপ্তের বিষয়টি সামনে আসে। মামুন হত্যার ঘটনায় চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য বেরিয়ে আসছে। ডাব খাওয়ানোর কথা বলে মামুনকে হাসপাতালের গেটে ডেকে আনে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী কামাল। জেল থেকে বের হয়ে গত ছয় মাস ধরে মামুনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে এই কামাল। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা দু’টি পিস্তল কেনা হয় পাঁচ লাখ টাকায়। হত্যার নেপথ্যে মামুনের সঙ্গে তার এক সময়কার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও মামুন একসময় হাজারীবাগ, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার আতঙ্ক ছিলেন। তাদের গড়ে তোলা বাহিনীর নাম ছিল ‘ইমন-মামুন’ বাহিনী। তারা দু’জনই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলার আসামি। ইমন ও কামালের সঙ্গে মিলে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করলেও ২০২৩ সালে মামুন কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে নিজের বলয় তৈরির চেষ্টা করে। এতেই ইমন গ্রুপের সঙ্গে চরম শত্রুতার সৃষ্টি হয়। ওই সময় কারাগার থেকেই মামুনকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করে ইমন। তখন থেকেই মামুন আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের সঙ্গে হাত মেলায়। জিসান বিদেশে থাকলেও তার গ্রুপের ক্যাডারদের সঙ্গে নিয়ে নতুন চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য গড়ে তোলে মামুন। রাজধানীর আফতাবনগর, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও এলাকা মামুন ও জিসানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। ইমনের চাঁদাবাজির বাধা হয়ে দাঁড়ায় মামুন ও জিসান।  এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যা করা হয়। 

পল্লবী থানা যুবদলের সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়াকে হত্যার ঘটনায় যে ৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা সবাই বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনের অনুসারী। কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেয় ৬ জন। তাদের হাতে ছিল স্বয়ংক্রিয় নাইন-এমএম পিস্তল। গুলি চালায় ৪ জন। সব মিলিয়ে ১৮ রাউন্ড গুলি খরচ করে শুটাররা। এ ঘটনায় এজাহারনামীয় দুই আসামি গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব জানিয়েছে, এই আসামিরা পেশাদার হত্যাকারী এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। পাতা সোহেলের নামে একাধিক হত্যা, ডাকাতি, মাদকসহ পল্লবী থানায় মোট ৮টি মামলা রয়েছে। এরা  দু’জনই মিরপুরকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা ফোর স্টার গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। মূলত, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিম ও মামুন নিয়ন্ত্রিত যেসব এলাকা রয়েছে সেসব এলাকায় এই ফোর স্টার গ্রুপের সদস্যরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। বিদেশ থেকে মামুনই এদের নিয়ন্ত্রণ করছে। এই পাতা সোহেলও এই হত্যাকাণ্ডের আগে দুবাই যায়। সেখানে গিয়ে কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে। আর যারা কিবরিয়ার কাছে থেকেও তাকে দেখতে পারছিল না বা কিবরিয়ার একক আধিপত্য মেনে নিতে পারছিল না তারাই এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের মাস্টার মাইন্ড। তারাই এই পাতা সোহেলকে অর্থের জোগান দিয়েছে। র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মাহবুব আলম বলেন, নিহত গোলাম কিবরিয়া একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য সচিব এবং মিরপুর এলাকায় রাজনৈতিকভাবে খুব সক্রিয় ছিলেন। এর আগে গোলাম কিবরিয়ার যাদের সঙ্গে সখ্যতা ছিল, একসঙ্গে জেল খেটেছেন, রাজনীতি করেছেন, রাজনৈতিক মেরূকরণের পরে সেই সখ্যতার বিরুদ্ধে তিনি কাজ শুরু করেন। বিশেষ করে এলাকায় চাঁদাবাজি ও মাদক কারবারিতে নিহত গোলাম কিবরিয়ার সাপোর্ট ছিল না। এ ছাড়াও স্থানীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে কিবরিয়ার হাতে চলে আসতে থাকে। এই জন্য তলে তলে তার কাছের অনেক মানুষ তার শত্রু বনে যায়। তারাই ঘটনার নেপথ্যে থেকে এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। 

আন্ডারওয়ার্ল্ডের খোঁজখবর রাখে এমন সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শীর্ষ সন্ত্রাসী আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু ও আরমান কারাগার থেকে মুক্তি পান। মোল্লা মাসুদও দেশে ফিরে আসেন ভারত থেকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরেন আমিন রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর। তারা তাদের পুরনো আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এতে জেলে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মূলত আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি দখলবাজির জেরেই তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। বেশ কিছুদিন ধরে শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন, সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ ও ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল গ্রুপের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির বিষয়টি অনেকের মুখে মুখে। যদিও তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে কুষ্টিয়া থেকে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। নজরদারিতে রাখা হয় আরও কয়েকজনকে। বিষয়টি টের পেয়ে দেশ ছাড়েন পিচ্চি হেলাল। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তেজগাঁও সাত রাস্তায় মামুনকে লক্ষ্য করে গুলি করে ইমন গ্রুপের সদস্যরা। তখন ইমন কারাগারে বন্দি ছিলেন। ওই ঘটনায় তারিক সাইফ মামুন আহত হলেও নিহত হন পথচারী ভুবন চন্দ্র শীল। 

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মিরপুরে নতুন করে গড়ে উঠেছে নতুন একটি আন্ডারওয়ার্ল্ড গ্রুপ ‘ফোর স্টার’। এই গ্রুপের দাপটে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে মিরপুরের বাসিন্দারা। এ ছাড়া জামিনে মুক্ত হয়ে মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, ফার্মগেট, মতিঝিল, মগবাজার ও পুরান ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কয়েকজন। শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন, ইব্রাহিম, শাহাদাত ও মুক্তার মিলে গড়ে তোলে ‘ফোর স্টার গ্রুপ’। এই সন্ত্রাসী গ্রুপটির গডফাদাররা বিদেশে থাকলেও তাদের হয়ে দেশে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কাজ করছে প্রায় ১০০ স্থানীয় সন্ত্রাসী। সম্প্রতি ৫ কোটি টাকা চাঁদা না পেয়ে মিরপুরের পল্লবী থানাধীন সাগুফতা এলাকার একে বিল্ডার্সে হামলা করে সন্ত্রাসী মামুনের ক্যাডাররা। হামলাকারীদের বেশির ভাগই উঠতি বয়সি তরুণ, কিশোর গ্যাং সদস্য। সবার হাতেই ছিল দেশি-বিদেশি অস্ত্র। একইভাবে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে ভাসানটেকে বেলায়েত হোসেনের বাড়িতে তাণ্ডব চালায় কিলার ইব্রাহিম বাহিনীর সদস্যরা। এ ছাড়াও আগারগাঁও এবং কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ-প্রকাশের নাম বলে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাচ্ছে থানা পুলিশ।

গোয়েন্দা তথ্য বলছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যতম মাফিয়া ইমন থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ঢাকার মাফিয়া ডন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ডেরায় বসে কলকাঠি নাড়ছেন। মোহাম্মদপুরের আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ আন্ডারওয়ার্ল্ডে তৎপরতা চালাচ্ছেন। মালয়েশিয়া থেকে রাজধানীর ধানমণ্ডি, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড ও হাজারীবাগ এলাকায় সন্ত্রাসী বাহিনী পরিচালনা করছেন সানজিদুল ইসলাম ইমন। মোহাম্মদপুর ও আশপাশ এলাকায় নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী চালাচ্ছেন পিচ্চি হেলাল। ইতিমধ্যে দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও খুনোখুনিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ইমন, পিচ্চি হেলাল এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও জিডি হয়েছে। গত বছর ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকেই ইমন ও পিচ্চি হেলাল বাহিনীর মধ্যে আধিপত্যের লড়াই চলছে। একপর্যায়ে পিচ্চি হেলাল দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় মোহাম্মদপুরের নিয়ন্ত্রণও চলে গেছে ইমনের হাতে। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ গ্রেপ্তারের পর মামুন ওইসব এলাকার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন। ওদিকে ক্লাবপাড়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান গ্রুপের সদস্যরা। 

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, এটা জাতীয় ও রাজনৈতিক একটা সমস্যা। শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে নির্মূল করা সম্ভব না। কারণ এই সমস্যা নিয়ে রাজনৈতিক কোনো কমিটমেন্ট নাই। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিভৃত করা, দমন করার সিদ্ধান্ত সেখান থেকেই আসতে হবে। তা না হলে একেক সময় একেক সন্ত্রাসী আসবে। তিনি বলেন, জাতীয় পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয় তখন তারাও তৎপর হতে বাধ্য। মূলত এটি নিয়ে যাদের মাথাব্যথা করার কথা তারা এটি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। বরং এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তারা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছেন। তারাই এদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে।