Image description

রাজধানীসহ সারা দেশে শক্তিশালী ভূমিকম্পের ঘটনায় কারও হাত ভেঙেছে, কারও পা ভেঙেছে, কেউ আবার পড়ে গিয়ে মাজায় ব্যথা পেয়েছেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরলেও এখনো হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন অনেকে। গতকাল রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে এমনই চিত্র উঠে এসেছে।

সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, শুক্রবারের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তাড়াহুড়ো করে ভবন থেকে বের হতে গিয়ে আহত হয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র-পঙ্গু হাসপাতালে ২৩ জন ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে- মো. ইসহাক (৮০), হুমায়ুন কবির (৬৫), বিউটি বেগম (৩৫), শুভারানী (৬০), আব্দুস সোবহান (৫৪), মাজেদা বেগম (৫০), বেলাল হোসেন (৪৮), মো. মহসিন (৪০), তানজিমা (৪০), রিপন মিয়া (৩৮), রবিন হোসেন (৩৮), আল-আমীন (৩২), সাদত হোসেন (৩০), কৃষ্ণ (২৬), ফরিদুল ইসলাম (২৬), সৈয়দ হোসেন (২৪), সজীব (২৪), জামিনুর রহমান (২৩), আবজাল হোসেন (১৯) ও আশিকুর রহমান (৮)সহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে একজন বিউটি বেগম। রাজধানীর আশুলিয়ার একটি তিনতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ভাড়া থাকেন এই দুই সন্তানের জননী। ভবন থেকে পড়ে গিয়ে কোমরে আঘাত পেয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, শুক্রবার সকালে ছাদে কাপড় শুকাতে গিয়েছিলাম। রশিতে কাপড় ঝোলাচ্ছি এর মধ্যেই বিল্ডিংটা দুলতে শুরু করলো। নিচের রাস্তা, পাশের ভবন- সব যেন কেমন দুলছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথা ঘুরে তিনতলা ছাদ থেকে নিচে পড়ে যাই। জ্ঞান ফিরে কিছু বুঝে ওঠার আগে দেখি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। পায়ে, মাজায় প্রচণ্ড ব্যথা। নড়া-চড়াও করতে পারছি না। বিউটির বেডের পাশে বসে থাকা তার বৃদ্ধ মা হানুফা বেগম বলেন, ভূমিকম্পের সময় আমরা ঘরের মধ্যে ছিলাম। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। এর মধ্যেই বিকট শব্দ। সকলে চিল্লাচিল্লি করছে। বাইরে এসে দেখি আমার মেয়ে অজ্ঞান হয়ে ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেছে। পরে আশপাশের মানুষের সাহায্য নিয়ে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সাভারের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে এই পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। তিনি বলেন, বিউটি মাথা, ঘাড়, কোমর ও পায়ে আঘাত পেয়েছেন। ডাক্তার অনেকগুলো টেস্ট দিয়েছে। এখন ভয়তে আছি আমার মেয়ের কোমরের হাড় যেন ভেঙে না যায়। 

শুক্রবারের ভূমিকম্পের সময় দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সময় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে কোমর, উরু ও হাতে গুরুতর আঘাত পান রাজধানীর নতুন বাজারের বেরাইদ এলাকার বাসিন্দা তানজিমা ফেরদৌস। পরে তাকেও ভর্তি করা হয় পঙ্গু হাসপাতালে। হাত ভেঙে গিয়েছে। তিনিও কোমর নিয়ে নড়াচড়া করতে পারছেন না। এদিকে আব্দুল্লাহপুরের বাসিন্দা ইয়াসিন আরাফাত বলেন, শুক্রবারও তার অফিসে ছিল। অফিসে বসে তিনি কাজ করছিলেন। ভূমিকম্পের সময় হঠাৎ আলমারি পড়ে তার ডান হাত ভেঙে যায়।  মিরপুর ৬নং এলাকার বাসিন্দা মনির হোসেনও আতঙ্কে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে বাম পা ভেঙে  পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি। 

ভূমিকম্পের সময় জুরাইন টাওয়ারের নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে গিয়ে দুই পায়ে আঘাত পান রাজমিস্ত্রি ধলাই। তিনিও ভর্তি রয়েছেন পঙ্গু হাসপতালে। ভূমিকম্পের সময়ের সেই ভয়াল স্মৃতিচারণ করে ধলাই বলেন, আমি জুরাইন রেলগেট এলাকার খন্দকার গেটে একটি বাসায় ভাড়া থাকি। ভূমিকম্পের সময় আমি একটি নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের ৬ তলায় ছিলাম। হঠাৎ দেখি বিল্ডিংটা দুলতে শুরু করলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি ৬তলা থেকে ৫ তলায় পড়ে যাই। তারপর আর ওঠে দাঁড়াতে পারিনি। পরে আমাকে উদ্ধার করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। 

এরপর সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটির ১-এ ভর্তি আছি। বিছানা পাইনি বলে ফ্লোরেই পড়ে আছি। তিনি বলেন, আমি গরিব মানুষ দুই পা ভেঙে গেছে। এখন আমি আমার সংসার নিয়ে চিন্তায় আছি। কতোদিন এভাবে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে সেটাও জানি না। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে আসা মো. সুবহানও বাম পায়ের হাঁটুর বাটি ভেঙে প্লাস্টার করে ক্যাজুয়ালিটির ১-এর ফ্লোরে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।  সুবহান বলেন, আমি একজন চটপটি বিক্রেতা। সকালের দিকে একটি দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ মাটিসহ ঝাঁকুনি শুরু হয়। এরপর দেখি যে যার মতো দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। আমিও ভয় পেয়ে দৌড় দেই। এ সময় একজনের সঙ্গে আমার ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়ি। এরপর থেকে বাম পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারছি না। পায়ের হাঁটুর বাটি ভেঙে গেছে।

বিষয়টি পঙ্গু হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স লক্ষ্মী রানী দাস বলেন, ভূমিকম্পের আতঙ্কে আহত হয়ে অনেকে আমাদের এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে যাদের ভর্তি দেয়া হয়েছে তাদের বেশির ভাগই হাত-পা ফ্র্যাকচার, কোমর ও কাঁধের জোড়া সরে যাওয়াসহ গুরুতর সমস্যায় ভুগছেন। 

বিষয়টি নিয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে-পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কেনান বলেন, শুক্রবার ভূমিকম্পে বিভিন্ন কারণে আহত হয়ে আমাদের হাসপাতালে মোট ১১৯ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ২৩ জন রোগী আমাদের এখানে ভর্তি রয়েছেন। ২৩ জনের মধ্যে তিনজন নারী আছেন একজন শিশু এবং বাকিরা পুরুষ চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদের বেশির ভাগ রোগী প্যানিকের কারণে আহত হয়েছেন। কেউ তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে, কেউ বা লাফিয়ে পড়ে, কেউ বাহিরে বের হলে ওপর থেকে কিছু পড়েছে এবং কেউ জানালা বা রেলিং ধরে ঝুলে ছিল পরবর্তীতে পড়ে আহত হয়েছেন।

এদিকে, ভূমিকম্পে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও চিকিৎসা নিয়েছেন শতাধিক মানুষ। এদের মধ্যে অন্তত ৮ জনকে ভর্তি দেয়া হয়েছে।  তাদের মধ্যে কামাড়পাড়ার রিকশাচালক আব্দুল মোতালেব একজন। তিনি বলেন, প্রতিদিনের মতো রিকশা চালাতে বের হয়েছিলাম। ভূমিকম্পের সময় রিকশা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যাই আমি। পাঁচ মিনিট রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষটির পাশে কেউ ছিল না। পরে স্থানীয়রা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডান পা ভেঙে গেছে। অপারেশন লাগবে। ভূমিকম্পের সময় সাততলা ভবনের সিঁড়ি বেয়ে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে পড়ে যান মহাখালীর রাশি সেন। তার স্বামী মনজ মধু বলেন, প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। কান্নাকাটি করছে, ভয় পাচ্ছে। আমি তাকে কীভাবে সামলাবো? মীরবাগের বাসিন্দা আবুল খায়েরকেও জরুরি বিভাগে ভর্তি দেয়া হয়েছে। তিনি মাথায় আঘাত পেয়েছেন। দিনমজুর খায়ের বলেন, দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি। ভয় নিয়ে বেঁচে রয়েছি। বড় ভাগ্য জানটা এখনো রয়েছে। তিনি বলেন, হাতিরঝিল থানার মীরবাগের ১৬ নম্বর কলোনিতে মো. বাদশার হোটেলে শুক্রবার ভূমিকম্পের সময় নাশতা করছিলাম আমরা তিনজন। ভূমিকম্পে পাশের নির্মাণাধীন সাততলা ভবনের কার্নিশ ভেঙে পড়ে টিনশেড হোটেলের ওপর। টিন ভেঙে ওই তিনজন চাপা পড়েন। হোটেলের মালিক বাদশা বাইরের দিকে ছিলেন বলে তিনি রক্ষা পেয়েছেন। আশপাশের লোকজন টিন সরিয়ে তিনজনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমার আর আবু সিদ্দিকের অবস্থা খারাপ।  সিদ্দিকের মাথা কেটে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং খালেকের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত লেগেছে।

অপরদিকে, রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাজহারুল ইসলাম খান বলেন, শুক্রবার ভূমিকম্পের সময় আহত হয়ে তাদের হাসপাতালেও ২০ জনের মতো চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন মারা গেছেন। আহতদের মধ্যে একজনকে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।