Image description

দুইদিনে চার দফা ভূমিকম্পে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। শুক্রবার সকালে রাজধানী ও আশপাশের জেলায় ভয়াবহ ভূকম্পন অনুভূত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এটি ছিল বেশি মাত্রার ভূমিকম্প। এই ভূমিকম্পের ঠিক ২৪ ঘণ্টার মাথায় গতকাল সকালে আবার কম্পন অনুভূত হয়। আগেরটির মতো এর কেন্দ্র ছিল নরসিংদী। সন্ধ্যায় ফের দুই দফা কম্পন অনুভূত হয়। এ দুটি কম্পনের একটি কেন্দ্র নরসিংদী এবং অন্যটির কেন্দ্র ঢাকার কাছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। পর পর এভাবে ভূমিকম্প হওয়ায় জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং শিক্ষার্থীদের ট্রমা কাটাতে রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে। 

শুক্রবারের ভূকম্পনে সারা দেশে দুই শিশুসহ ১১ জনের প্রাণহানি হয়েছে। কয়েকশ’ মানুষ আহত হন। আহতদের অনেকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এই ভূমিকম্পের ভয়াবহ ট্রমা কাটানোর চেষ্টার মধ্যেই গতকাল পর পর তিন দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়। সকালে হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৩.৩। সন্ধ্যায় প্রথমটি ৩.৭, পরেরটির মাত্রা ছিল ৪.৩। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যে আরও এমন ভূকম্পন হতে পারে। এর মাধ্যমে পুরো সিস্টেম ব্যালেন্স হবে। এই অংশে বড় ভূমিকম্প আপাতত না হলেও বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছে।

শুক্রবার সকালে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল নরসিংদীর মাধবদীতে। শনিবার এই জেলারই পলাশ উপজেলায় সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে ১২ সেকেন্ডের ভূকম্পন হয়। এটির উৎপত্তিস্থল ঢাকার ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে ২৯ কিলোমিটার দূরে বলে আবহাওয়া অফিস জানায়। প্রথমে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছিল ঢাকা জেলার সাভারের বাইপাইলে ভূমিকম্পের কেন্দ্র। বিকালে সেই তথ্য সংশোধন করা হয়। শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটে পাশাপাশি সময়ে দুটি ভূমিকম্প হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ভূমিকম্প দুটির উৎপত্তিস্থল রাজধানীর বাড্ডা ও নরসিংদীর পলাশে। আবহাওয়া অফিস জানায়, শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩.৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। এর ১ সেকেন্ড পর সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয়বার ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এটির মাত্রা ৪.৩। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানায়, সন্ধ্যায় হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪.৩। যার উৎপত্তিস্থল নরসিংদী থেকে ১১ কিলোমিটার পশ্চিমে।

বারবার হওয়া এই ভূমিকম্পের বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. ইউনুস আহমেদ খান বলেন, এগুলো আফটারশক। ফল্টের মুভমেন্টের কারণে এই ভূমিকম্প হয়। এই ফল্ট এরিয়াগুলোতে অনেকদিন ধরে শক্তি সঞ্চিত হয়। এটা কয়েকশ’ বছর ধরে হতে পারে। তবে আমাদের এই এলাকায় অন্তত একশ’ বছর ধরে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। শক্তিগুলো এতটা শক্তিশালী হয়ে যায় যে, সেখানকার মাটি ধরে রাখতে পারে না। একটা বড় শক্তি শুক্রবার নির্গত হয়ে গেছে। একটা বড় এলাকা জুড়ে একটা অবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে গেছে। ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। ভারসাম্য আসতে দুই একদিন থেকে দুই এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। ছোট শক্তিগুলো নির্গত হয়ে একটা ভারসাম্য চলে আসবে। এজন্য আরও দুই একটা হয়তো ভূমিকম্প হতে পারে। এটা নিয়ে ভীত হওয়ার কিছু নাই। আপাতত এই যাত্রায় বড় ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে যেহেতু অনেক শক্তি সঞ্চিত আছে সেহেতু সামনে আরও বড় ভূমিকম্প হতে পারে। সামনে সিলেট, সুনামগঞ্জ এই অঞ্চলে ভূমিকম্প হতে পারে। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইন্ডিয়ান প্লেটের উপর আছে। আমাদের এই প্লেটের সঙ্গে ইউরেশিয়ান একটা প্লেটের যোগ আছে। আবার বার্মিজ সাব-প্লেটের সঙ্গে একটা সংযোগ আছে। এই সাব-প্লেটের নিচে ইন্ডিয়ান প্লেটটা চলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বছরের ৭/৮ থেকে ১০/১২ মিলিমিটার করে। প্লেট হচ্ছে মাটির শক্ত অংশগুলো। প্লেট যেহেতু ঢুকে যাচ্ছে উপরের অংশগুলোর যাওয়ার জায়গা পাচ্ছে না। জায়গা না থাকায় অংশগুলো উপরের দিকে উঠতে থাকে। এভাবে নিচু ভূমি উঁচু হয়ে যায়। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল কাদের বলেন, শনিবারের ভূমিকম্পগুলো আফটারশক। আফটারশক সাধারণত কম মাত্রার হয়ে থাকে। এটি বড় ভূমিকম্পের ৭২ ঘণ্টার মাঝে হয়ে থাকে। এখন যে ছোট ছোট ভূমিকম্প হচ্ছে তা বড় ভূমিকম্পের আভাস। আমাদের এখানে তো বড় ভূমিকম্প হয়েছিল অনেক আগে। এখানে বিপুল পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে। এক্ষেত্রে আমাদের স্বল্প ও দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতি রাখতে হবে। শুক্রবার আমরা দেখেছি ভূমিকম্পের ফলে বেশকিছু পাওয়ার স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে পাওয়ার স্টেশন এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা আরেকটি বিষয় শুক্রবার লক্ষ্য করেছি, ভূমিকম্পের সময় তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে অনেকে আহত হয়েছেন। এভাবে নামার সময় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থেকে যায়, নামার সময় সিঁড়িটা ধসে যেতে পারে। তাই আমাদেরকে যে যেখানে থাকে তার জায়গাটা ভালোভাবে চিনতে হবে। তাড়াহুড়ো করে না নেমে শক্ত কিছুর নিচে আশ্রয় নিতে হবে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মাহবুব বলেন, ভৌগোলিকভাবে ইন্ডিয়ান, বার্মিজ এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এখানে আসাম ফল্ট, ডাউকি ফল্ট ও উত্তর-পূর্বে মিয়ানমারের সেগাইং ফল্টের মতো ফাটল রয়েছে। ফলে আমাদের এখানে বিভিন্ন সময় ছোট ও মাঝারি মাত্রার কম-বেশি ভূমিকম্প হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে যেতে পারে।

তিনি বলেন, সে অনুযায়ী আমাদের তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই। ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরে গ্যাসের লাইনগুলো ফেটে যাবে, বিদ্যুৎ লাইনগুলো ছিঁড়ে যাবে, নেগেটিভ পজেটিভ তার একত্রিত হয়ে আগুন জ্বলতে থাকবে। তাই ঢাকা শহরের পুরাতন বিল্ডিংগুলো অর্থাৎ যেগুলো ভূমিকম্প সহনীয় নয়, সেগুলো আইডেন্টিফাই করে ভেঙে ফেলতে হবে। ভূমিকম্প সহনীয় নতুন ভবন তৈরির জন্য বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। সর্বোপরি ঢাকা শহরকে ডিসেন্ট্রালাইজ করতে হবে। তাহলেই হয়তো ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি থেকে আমরা কিছুটা রেহাই পেতে পারি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা: বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, সামপ্রতিক ভূমিকম্পের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং সম্ভাব্য মানসিক ট্রমা বিবেচনায় রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের উপ-পরিচালক ফররুখ মাহমুদ প্রেরিত বার্তায় বিষয়টি জানানো হয়। এতে আরও বলা হয়, পরিস্থিতি মূল্যায়ন শেষে পরবর্তী করণীয় ও সিদ্ধান্তসমূহ শিগগিরই জানানো হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সকল শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীর নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। 

ভূমিকম্প আতঙ্ক, জবির সকল ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা: 
জবি প্রতিনিধি জানান,  রোববার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। তবে জকসু কার্যক্রম চলবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম। শনিবার রাজধানীতে কয়েক দফায় ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই সিদ্ধান্ত নেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, রাজধানীতে বার বার ভূমিকম্প হওয়াতে শিক্ষার্থীসহ সকলের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফলে আমরা ক্লাস পরীক্ষা  রোববার বন্ধ রাখছি।