Image description
৫০ জেলার মধ্যে আইসিইউ স্থাপন মাত্র ১৩টিতে । ১৬ মেডিকেলে পিআইসিইউ এবং ১৫টিতে অবস-আইসিইউ’র একটিও বসেনি ।

করোনা থেকে দেশের মানুষের জীবন রক্ষায় ২০২০ সালে নেওয়া প্রকল্পের বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা এখন জনগণের ঘাড়ে। প্রকল্পটি শেষ হলেও লক্ষ্য পূরণে আসেনি সফলতা। এটি ছিল বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেসমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) ঋণের অর্থে। এই প্রকল্পের অধীনে দেশের ৫০ জেলার সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনের কথা ছিল। বাস্তবে মাত্র ১৩ জেলায় নামমাত্র আইসিইউ বসানো হয়। যেখানে নেই দক্ষ জনবল।

অপরদিকে ১৮টি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (পিআইসিইউ) এবং ১৫টিতে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ এপিনিয়া ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (অবস-আইসিইউ) স্থাপনের কথা থাকলেও এর একটিতেও বসানো হয়নি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ‘নিবিড় পরিবীক্ষণ’ প্রতিবেদনে ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডামিক প্রিপায়ার্ডনেস নামক প্রকল্পের এই দুরবস্থা উঠে এসেছে।

প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১ হাজার ১২৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ২৭৭ কোটি ৫১ লাখ এবং বিশ্বব্যাংক ও এআইআইবি’র ঋণ থেকে ৮৫০ কোটি টাকা ধরা হয়। কিন্তু ২০২১ সালে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৬ হাজার ৭৮৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা করা হয়। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১৭২ কোটি এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে ৬ হাজার ৬১৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। পরে ২০২২ সালে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে মোট ব্যয় কিছুটা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ৬ হাজার ৩৮৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এই অর্থের মধ্যে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। অপরদিকে বৈদেশিক ঋণের অংশে কমে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৯১৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ৪ হাজার ৭১৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, যা মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৭৩ দশমিক ৯০ শতাংশ।

এদিকে প্রকল্পে স্বাস্থ্য খাতের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ খাতে সাড়ে ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও খরচ হয়েছে মাত্র ১৫ লাখ টাকা। প্রতিবেদনে প্রকল্পের নানা দুর্নীতি এবং অডিট আপত্তির নিয়মভঙ্গের ঘটনাও ঘটেছে। এমন বাস্তবতায় প্রকল্পের মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানোর প্রস্তাব নাকচ করা হয়। কী কারণে প্রকল্পের এই দশা হলো সে বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাকাউন্টসংক্রান্ত জটিলতা, এলসি সমস্যা, ডলারের বিপরীত টাকা অবমূল্যায়ন এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পটির ৬ মাস মেয়াদ বাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি আর হয়নি। কেননা বাস্তবায়নের যে অবস্থা এতে মেয়াদ বাড়ালে উলটো আরও খরচ বাড়ত। এসব কারণে প্রকল্পটি যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায়ই সমাপ্ত করা হয়েছে।

আইএমইডি জানায়, ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে শুরু হয়ে ২০২৩ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটি হাতে নেয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু নানা জটিলতা থাকায় দ্বিতীয় সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের বিষয়ে এসব প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় ঠিকই, কিন্তু তারা তেমন গুরুত্ব দেয় না। পৃষ্ঠা উলটেও দেখে কিনা সেটি নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমার সময় একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। উদ্যোগটি ছিল-মূল্যায়ন করা সব প্রকল্পের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ নিয়ে একটি আলাদা প্রতিবেদন তৈরি করে সেটি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দেওয়া। এটি করা গেলে কিছুটা হলেও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হতে পারে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব বা সংস্থা প্রধানদের উচিত আইএমইডির প্রতিবেদনগুলো সিরিয়াসলি নেওয়া।

৫০টি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনের কথা থাকলেও মাত্র ১৩টি করায় প্রকল্পের আওতায় প্রধান কাজ আইসিইউ স্থাপনের অগ্রগতি যথেষ্ট হতাশাজনক বলে ‘নিবিড় পরিবীক্ষণ’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আবার যেসব হাসপাতালে আইসিইউ এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে সেগুলোতে রাজস্ব খাতে কোনো পদ সৃজন বা জনবল নিয়োগ না দেওয়ায় এগুলো সচল রাখা যাচ্ছে না। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পের পণ্য ও সেবা ক্রয়ের কাজ বাস্তবায়ন হয় প্রকল্প অফিসের মাধ্যমে। অপরদিকে পূর্ত বা নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। এই দুই দপ্তরের সমন্বয়ের অভাবে নির্মাণকাজ শুরু করতে অস্বাভাবিক দেরি হওয়ায় সবগুলো আইসিইউ স্থাপন করা যায়নি।

প্রতিবেদনে প্রকল্প বাস্তবায়নে অ্যাকাউন্টসংক্রান্ত জটিলতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। বিশ্বব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী একটি কনটাসা অ্যাকাউন্ট (কনভারটেবল টাকা স্পেশাল অ্যাকাউন্ট) খোলার কথা এবং সেটি করাও হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু নির্মাণকাজ গণপূর্ত অধিদপ্তর করে, ফলে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে আরও একটি কনটাসা অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। এজন্য নানা অনুমোদন এবং প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রায় ২ বছর সময় চলে যায়। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকা দ্রুত ছাড় হলেও জটিলতা দেখা দেয় এআইআইবি’র অর্থছাড়ে। এই প্রক্রিয়া শেষ করতে বিশ্বব্যাংক যেখানে সময় নেয় ১৪ দিন, এআইআইবি সেখানে ৭০ দিন সময় নিয়েছে। ফলে ১৮৪টি বিলের বিপরীতে ৭৪ কোটি টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে গত পাঁচ বছরে বৈদেশিক সহায্যপুষ্ট এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে অডিট অধিদপ্তর ৪৬৪ কোটি টাকার ৭৬টি অডিট আপত্তি দিয়েছে। এর মধ্যে ৮টি অডিট নিষ্পত্তি হওয়ার তথ্য প্রকল্প অফিস থেকে পাওয়া গেছে। বাকিগুলোর ব্যাপারে ব্রডশটি আকারে জবাব দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী সরকারি ক্রয় আইন না মেনে অনভিজ্ঞ ও অযোগ্য সরবরাহকারীর সঙ্গে চুক্তি, আয়কর ও ভ্যাট কম কাটা বা না কাটা, আয়কর ও ভ্যাট থেকে কাটা অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়া এবং নির্দিষ্ট সময়ে মালামাল সরবরাহ না করলেও বিলম্ব জরিমানা আদায় করা হয়নি।

ইআরডির সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আযম যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পটি যেহেতু লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, সেহেতু এই ঋণ কার্যকরভাবে ব্যয় হয়নি বলে মনে করা হচ্ছে। ঋণের যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে তা সরকারকে পরিশোধ করতে হবে। এভাবে জনগণের ঘাড়েই চাপল। সব সময় মনে রাখতে হবে যে কোনো ঋণের টাকা খরচে সতর্ক হতে হবে। কার্যকর ব্যবহার না হলে সেই ঋণটাই বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এখানে প্রকল্পটি কেন বাস্তবায়ন হয়নি তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।