বাংলাদেশের জন্য বহির্র্বিশ্বের শ্রমবাজার হুমকির মুখে পড়েছে। অক্টোবর মাসেই বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতে বড় ধরনের ধস নেমেছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই বিদেশে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ হয়ে যাবে। সরকারের উচ্চ মহল থেকে কূটনৈতিকভাবে এ সকল সমস্যার সমাধান করতে না পারলে এ সমস্যার সমাধান কঠিন হবে। তবে বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু কিছু দেশে নতুন শ্রমবাজার তৈরিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। সে সকল মার্কেটে নতুন সম্ভবনা তৈরি হচ্ছে।
ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিএমইটি) সূত্রে জানা গেছে, অক্টোবরে বাংলাদেশ থেকে মোট ৭৮,০২৭ জন কর্মী বিদেশে গেছেন, যা সেপ্টেম্বরে প্রেরিত ৯৫,৬৯৪ জনের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ কম।
গন্তব্যভিত্তিক কর্মী প্রেরণ ॥ বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর মাসে সৌদি আরবে গেছেন ৪০,৬১২ জন, কাতারে ১১,৪০৮ জন, সিঙ্গাপুরে ৬,২৬৩ জন, মালদ্বীপে ৫,০৪১ জন, কম্বোডিয়ায় ৩,৩৫৩ জন, কুয়েতে ২,১২২ জন, জর্ডানে ১,৩৮০ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১,৩২২ জন, ইরাকে ১,০৪০ জন, ইতালিতে ৭৯৬ জন, পর্তুগালে ৪৪১ জন কর্মী প্রেরণ করা হয়েছে।
সেপ্টেম্বরে ছিল রেকর্ড প্রেরণ ॥ সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ থেকে ৯৫,৬৯৪ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। তবে আগস্টের তুলনায় (১,৪২,৬৬৫ জন) তা ৩৩ শতাংশ কম। আগস্টে রেকর্ডসংখ্যক
কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ প্রেরণ হিসেবে বিবেচিত। সৌদি আরবেই সেপ্টেম্বরে সর্বাধিক ৫৯,৫০০ জন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়।
সৌদি আরবের সঙ্গে নতুন চুক্তি ॥ সৌদি আরবের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে হওয়া ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত হবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্টরা।
গত ৬ অক্টোবর রিয়াদে বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সাধারণ কর্মী প্রেরণ বিষয়ে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৭৬ সাল থেকে সৌদি আরব বাংলাদেশি কর্মী নিচ্ছে, তবে এতদিন কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছিল না। এর আগে ২০১৫ সালে গৃহকর্মী এবং ২০২২ সালে দক্ষতা যাচাই (এসভি) সংক্রান্ত দুটি চুক্তি হয়েছিল।
গত পাঁচ বছরে সৌদি আরবেই মোট প্রবাসী কর্মীর প্রায় ৫৭ শতাংশ (প্রায় ৪৫ লাখের মধ্যে ২.৫৭ লাখ) গেছেন বলে বিএমইটি জানিয়েছে। তবে এর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি কর্মী নিম্নদক্ষ পেশায় নিয়োজিত। অনেকেই প্রতিশ্রুতি মতো চাকরি না পাওয়া, বেতন অনিয়ম এবং ইকামা (বাসস্থানের অনুমতিপত্র) সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগছেন।
উজবেকিস্তানের সঙ্গে নতুন সম্ভাবনা ॥ এদিকে, গত সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (টঘএঅ) অধিবেশনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং উজবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাখতিয়ার সাইদভের মধ্যে বৈঠকে দুই দেশ আধা-দক্ষ ও দক্ষ জনশক্তি প্রেরণ বিষয়ে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়।
এ সময় কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা অব্যাহতি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়, যা দুই দেশের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার পথ তৈরি করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য ॥ সাবেক সৌদি আরবস্থ রাষ্ট্রদূত গোলাম মুশি বলেন, ‘সৌদি আরব এখন দক্ষ কর্মী নিয়োগে বেশি আগ্রহী, কারণ অনেক নিম্নদক্ষ কাজ স্থানীয়রাই করছে। এ জন্য তারা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নতুন নতুন চুক্তি করছে।’
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা’র) সাবেক ফখরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে প্রবাসে লোক পাঠানোর বাজার তুলনামূলক কম। সে জন্যদেশের বর্তমান অস্তিরতা অনেকাংশেই দায়ী।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি এবং মালয়েশিয়া। দুটো দেশই সিন্ডিকেটের কবল থেকে মুক্ত হতে পারছে না। যার ফলে দেশগুলোতে শ্রমিক পাঠানোও কঠিন হয়ে পড়ছে। সরকারের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এ সকল সমস্যার সমাধান না হলে শ্রমমার্কেট অশনি সংকেতে পড়বে। যা থেকে উত্তোলন খুবই জরুরি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা’র) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, ‘আমরা এখনো বেশিরভাগ কর্মীকে ক্লিনার, নির্মাণশ্রমিক ও গৃহকর্মী হিসেবে পাঠাচ্ছি, যাদের বেতন ৩০,০০০ টাকার বেশি নয়। নতুন চুক্তির আওতায় যদি বেশি দক্ষ কর্মী পাঠানো যায়, তাহলে রেমিট্যান্স বাড়বে।’
অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের শ্রমিকদের চাহিদা কমার অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমত, পরিবেশ, অযোগ্যতা তো রয়েছেই। সে সঙ্গে জবাবদিহিমূলক সিস্টেম না থাকায় সেখানে কে কি করছে, সেখানে আদৌ লোকবলের প্রয়োজন রয়েছে কিনা, শ্রমিকদের আকামা তথা কাজের পারমিট আছে কিনা এ সকল বিষয়গুলোর জবাবদিহিতা নেই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এওইউ করে কিন্তু জিটুজি কোনো চুক্তি থাকে না। যা সমস্যার অন্যতম বড় কারণ! বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোও তাদের ব্যবসার কারণে সঠিক ইনফরমেশন দিতে চায় না। যা একজন শ্রমিকের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের শ্রমিকরা সরকারিভাবে যায়, সেখানে আমরা যদি তাদের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের পরিবর্তে আস্তে আস্তে বাইলেটারিক রিভেনটেক এর দিকে না আসি তাহলে এটা আরও সংকুচিত হয়ে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে ন্যূনতম বেতন ৬০০-৮০০ রিয়াল থেকে বাড়িয়ে ১,০০০ রিয়াল করার দাবি জানিয়ে আসছি। আশা করি, এই চুক্তির মাধ্যমে ন্যূনতম বেতন, ইকামা, বেতন পরিশোধসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান হবে।’
দক্ষতার যাচাই প্রক্রিয়া ॥ সৌদি আরব সম্প্রতি বিদেশি নিম্নদক্ষ কর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক স্কিল ভেরিফিকেশন প্রোগ্রাম (এসভিপি) চালু করেছে, যা বাংলাদেশি শ্রম রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তবে বাংলাদেশের অনুরোধে আপাতত কিছু ক্যাটাগরিতে তা শিথিল করা হয়েছে।
অক্টোবর মাসে জনশক্তি রপ্তানি কমলেও, নতুন চুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির ফলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির কাঠামোতে ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।