শুক্রবারের ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের আভাস দিচ্ছে। যে কোনো সময় বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ভূগর্ভেও বাড়ছে চাপ। শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার মতো অবস্থা সেখানে বিরাজ করছে। এই অঞ্চলের ভূমিকম্প জোন-আসাম ফল্ট, ডাউকি ফল্ট ও উত্তর-পূর্বে মিয়ানমারের সেগাইং ফল্টের চ্যুতি দিনে দিনে বাড়ছে। যা ভূমিকম্প হওয়ার মতো পরিবেশ ভূগর্ভে ত্বরান্বিত করছে। গত ৩০ বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের মানুষ ৫.৭ মাত্রার যে ভূমিকম্প দেখল তা এখানেই থেমে থাকবে এমনটি নয়। যে কোনো সময় দেশে ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, এই মাত্রা বা তার কাছাকাছি মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার মতো অবস্থা ভূগর্ভে তৈরি হয়ে আছে।
ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার বিষয়বস্তু তুলে ধরে শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, ওই গবেষণায় দেখা যায়, এ অঞ্চলে ভূগর্ভে দুটি প্লেট ধাবিত হচ্ছে। ইন্ডিয়া প্লেট পূর্বদিকে যাচ্ছে। বার্মা প্লেট পশ্চিমের দিকে আসছে। বার্মা প্লেটের নিচে ইন্ডিয়া প্লেট তলিয়ে যাচ্ছে। এটিকে বলে ‘সাবডাকশন জোন’। জিপিএসে পরিমাণ করে দেখা গেছে, প্রতিবছর ১ মিটার থেকে দেড় মিটার সংকোচন হচ্ছে। সে হিসাবে এই জোনে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অঞ্চলে প্রতি ১০০-১৫০ বছর পরপর ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হানা দেয়। আর প্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পরপর সংঘটিত হয় ৮ মাত্রার ভূমিকম্প। সে হিসাবে বাংলাদেশে সামনে ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা খুবই জোরালো। গত ৫-৬ বছরে ভূমিকম্পের হারও বেড়েছে।
শুক্রবারের ভূমিকম্পকে দেশে বড় ভূমিকম্পের আরেকটি আভাস-এমন মন্তব্য করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ আর্থকোয়াক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, শুক্রবারের ভূমিকম্পটির গভীরতা প্রায় ১০ কিলোমিটার। এটি ২০ সেকেন্ডের মতো স্থায়ী হয়। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ও তার আশপাশের অঞ্চলে ১০০-১৫০ বছরের মধ্যে ৬টি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। ১৮৬৯ সালে ৭.৬ মাত্রার কাছাড় ভূমিকম্প, ১৮৮৫ সালে ৭.১ মাত্রার বেঙ্গল ভূমিকম্প, ১৮৯৭ সালে ৮.১ মাত্রার গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্প এবং ১৯১৮ সালে ৭.৬ মাত্রার শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগের ইতিহাস রয়েছে এ অঞ্চলে।
ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ভূমিকম্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৭ মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ১০০ থেকে ১২৫ বছরের মধ্যে থাকে। আর যেগুলো ৮ মাত্রার সেগুলো সংঘটিত হয়েছে ২৫০-৩০০ বছর পরপর। ১৯৩০ সালের পর থেকে এই অঞ্চলে বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। কিন্তু অতীতের তথ্যের সঙ্গে মেলালে দেখা যায়, এ ধরনের বড় ভূমিকম্প আমাদের এই এলাকায় হওয়ার আশঙ্কা আছে। বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়, যা ইতোমধ্যে অনেকগুলো হয়েছে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে, আগে বাংলাদেশের আশপাশের দেশ ছিল বড় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। এবার সেটি ধরা দিয়েছে খোদ দেশের মাঝেই। দেশের ইতিহাসে ঢাকার সবচেয়ে কাছে উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর মাধবদীতে। এটি ছিল ঢাকার আগারগাঁও আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার পূর্বে। ঢাকার এত কাছে এত বড় মাত্রার ভূমিকম্প এটাই প্রথম। যা ভয়ের কারণ হিসাবে দেখছেন তারা। যদিও ঢাকা ও এর আশপাশে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল আগেও ছিল। পার্থক্য এতটুকুই-সেগুলোর মাত্রা ছিল কম।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান রুবাইয়াত কবির যুগান্তরকে বলেন, অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। ইন্ডিয়ান ও ইউরোশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলে এর অবস্থান। দেশের কিছু কিছু এলাকা অনেক বেশি ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে জানিয়ে রুবাইয়াত কবির বলেন, দেশের ‘আর্থকোয়েক রিস্ক জোন’-এর মধ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চল সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। এর মধ্যে রয়েছে সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা। অন্যদিকে দেশের মধ্যাঞ্চলের মধ্যে রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার-এগুলো ভূমিকম্পের মাঝারি ঝুঁকিতে আছে। তবে খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চল সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে রয়েছে।