Image description

ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেছেন, 'ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) কার্যালয়ের কাছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটা প্রথমবার দেখেই আমার মনে ভেসে উঠেছিল (ইরাকে) সাদ্দাম হোসেনের মূর্তি ভেঙে টেনে নেওয়ার সেই দৃশ্য। অন্তর্দৃষ্টি বলছিল, সুযোগ পেলেই এ দেশের মানুষ এগুলো ছুঁড়ে ফেলবে।' এর মধ্য দিয়ে তিনি ২০২৪ সালের আগস্টের অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ও তার নামে থাকা স্থাপনা ভাংচুরকে বৈধতা দেওয়ার ভাষ্য সামনে এনেছেন বলে অভিযোগ নেটিজেনদের।

'বিফোর হাসিনা লস্ট অব দ্য কোর্ট, সি হ্যাড লস্ট ইন দ্য কোর্ট অব দ্য পিপল' শিরোনামে এক উপসম্পাদকীয়তে মাহফুজ আনাম এই মন্তব্য করেন। তার লেখাটি আজ শুক্রবার (২১শে নভেম্বর) ডেইলি স্টারের ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটির লিংক ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে নানা শ্রেণি-পেশার নেটিজেন আলোচনা করছেন। লেখাটি একতরফা বিদ্বেষে ঠাসা বলেও তাদের অভিমত।

শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভাঙার এবং সেখানে জুতোর মালা পরিয়ে দেওয়ার দৃশ্য দেখে মাহফুজ আনামের এখন ইরাকের ক্ষমতাচ্যুত নেতা সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্য ভাংচুরের দৃশ্য মনে পড়লেও গত বছর তিনি এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছিলেন। তার আজকের মন্তব্য তাই স্ববিরোধী বলেই পাঠকদের অভিযোগ। আজকের উপসম্পাদকীয়তে তিনি বলেন, তার (শেখ হাসিনা) রাজনৈতিক জীবন দাফন হয়ে গেছে অহংকার, আত্মম্ভরিতা, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও পুলিশ-প্রশাসনকে মাথায় তুলে রাখার সংস্কৃতির নিচে।

নেটিজেনদের মতে, ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস ও আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে 'নিশ্চিহ্ন' করতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার যে পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে, মাহফুজ আনামের আজকের লেখাটি সেই পরিকল্পনার অংশ। অনেক নেটিজেন অভিযোগ করেন, বিএনপির প্রতি এখন প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের কৌশলগত কারণে একধরনের 'সফট কর্নার' দেখা গেলেও খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে রাজনীতি থেকে 'মাইনাস' করার পরিকল্পনাও পত্রিকা দুটির আছে।

এক এগারোর জরুরি অবস্থার তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পত্রিকা দুটির দুইনেত্রীকে (শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া) রাজনীতি থেকে 'মাইনাসের' কর্মকাণ্ডের  প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসছেন অনেক নেটিজেন। পত্রিকা দুটি তখন প্রকাশ্যেই দাবি জানিয়েছিল, দুইনেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার, বা সরে যাওয়ার।

আজ শুক্রবারের উপসম্পাদকীয়ের শুরুতেই মাহফুজ আনাম লেখেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) বিচারে শক্তিশালী অংশ বা দুর্বলতা কী—সেগুলো নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞেরা আলোচনা করবেন। আমাদের আলোচনার বিষয় হলো, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পতন এবং জনগণের, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে তিনি 'দোষী সাব্যস্ত' হয়েছেন অনেক আগে—২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সেই অভ্যুত্থানের দিনগুলোতেই।

অভিজ্ঞদের মতে, যে কোনো দেশের বিচারিক আদালতে মামলার বিচারকার্য শেষ হওয়ার পরও রায় ও বিচারপ্রক্রিয়ার পদ্ধতি বা ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার সুযোগ থাকে যে 'আদালতে', তা হচ্ছে গণমাধ্যম। চব্বিশের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত সোমবার (১৭ই নভেম্বর) সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের যে রায় ঘোষণা করেছেন, এ নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন দেশের অনেক সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞ।

মাহফুজ আনামের মতো পাঠকনন্দিত সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের কাছে পাঠকদের যখন এ বিষয়ে গভীর আলোচনার প্রত্যাশা, তখন তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন তার পত্রিকার গুপ্ত কৌশলের কারণে। এমনই অভিযোগ করছেন নেটিজেনেরা। কেউ কেউ তাকে সুযোগসন্ধানী সম্পাদক বলতেও ছাড় দিচ্ছেন না।

মাহফুজ আনাম লেখেন, আইনি দিকটি একপাশে রেখে বিবেচনা করলেও যারা সেই ভয়াবহ দিনগুলো স্বচক্ষে দেখেছেন, ঘটনাগুলো নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, সেগুলো নিয়ে লিখেছেন, সরকারকে সতর্ক করেছেন—তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা নিজ জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা দেখে মাহফুজ আনামের ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের মূর্তি ভেঙে টেনে নেওয়ার সেই দৃশ্য মনে পড়লেও তিনি ২০২৪ সালের ১৮ই অক্টোবর ডেইলি স্টারে এক উপসম্পাদকীয় লেখেন 'শেখ হাসিনার দুঃশাসনের মাপকাঠিতে বঙ্গবন্ধুকে বিচার করা ঠিক হবে না' শিরোনামে। সেখানে তিনি লেখেন, 'আমরা কোনোক্ষেত্রেই যেন শেখ হাসিনার আদ্যোপান্ত ত্রুটিপূর্ণ, অগণতান্ত্রিক, জনস্বার্থবিরোধী, দুর্নীতিগ্রস্ত, ক্ষমতালোভী, অসহিষ্ণু ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান মূল্যায়ন না করি।'

তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করা, আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন গড়ে তোলা, ছয় দফা দাবি তোলা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের বিস্ময়কর ফলাফল অর্জন, ৭ই মার্চের ভাষণ এবং ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে শুরু করে অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে কার্যত তৎকালীন পাকিস্তান সরকারকে অকার্যকর করে দেওয়া আমাদের ইতিহাসের গৌরবময় মুহূর্তগুলোর অন্যতম, যা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ও অবিসংবাদিত ভূমিকার কারণে।

তখন তিনি লেখেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই জনমানুষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা—বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা (অনেকটাই সাম্প্রতিক সময়ের মতো)—অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এর সবই সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পাহাড়সম ব্যক্তিত্ব, উপস্থিতি ও দ্ব্যর্থহীন নেতৃত্বের কারণে। গত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনা যা করেছেন, সেটা বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধুর এসব ভূমিকাকে আমরা কোনোভাবেই ছোট করে দেখতে পারি না।

প্রসঙ্গত, ২০০৩ সালে যখন মার্কিন দখলদার বাহিনীর ট্যাঙ্ক ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ঢুকে সাদ্দাম হোসেনের সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে, তখন ইরাকে মার্কিন অনুসারীদের মধ্যে আনন্দের পরিবেশ দেখা যায়। দেশটির ফিরদৌস স্কোয়ারে সাদ্দাম হোসেনের যে বিশাল ভাস্কর্য ছিল সেটা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন তারা। কিন্তু তাতে তারা সফল হননি। তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন সেখানে উপস্থিত মার্কিন সেনারা।

সাদ্দাম হোসেনের ১২ মিটার উঁচু এই ভাস্কর্য ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে নির্মাণ করা হয়েছিল। মার্কিন সেনারা সাদ্দাম হোসেনের মূর্তির গলায় লোহার শিকল জড়িয়ে এম৮৮ সাঁজোয়া যানের সঙ্গে বেঁধে টেনে নিয়ে যায়। এরপর ভেঙে পড়ে ওই ভাস্কর্য।