দেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের সাক্ষী হলো দেশ। এতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক মানুষ হতাহত হয়েছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য ভবন ও স্থাপনা। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে এখনো ভূমিকম্পের আতঙ্ক বিরাজ করছে। কিন্তু কিছু দিন পর পর কেন এই ভূকম্পন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কী বার্তা দেন, সেটাই জানিয়েছেন দেশের সচেতন কয়েকজন আলেম। নয়া দিগন্ত পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো-
আমাদের আল্লাহমুখী হতে হবে
ড. এবিএম হিজবুল্লাহ
সাবেক প্রফেসর, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
page-top-ad
আজ আমাদের বাংলাদেশে সকালবেলা প্রচণ্ড বেগে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। প্রশ্ন হলো- এই ভূমিকম্প আমাদেরকে কী বার্তা দেয়। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিশ্লেষণ হলো- ভূমিকম্প হচ্ছে এই পৃথিবীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি শাস্তির নিদর্শন। একটি হাদীসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘পৃথিবীতে এই উম্মতের শাস্তি হলো বিভিন্ন ধরনের ফেতনা, ভূমিকম্প এবং হত্যা।’ (আবু দাউদ)
ভূমিকম্প কেয়ামতের অন্যতম একটি নিদর্শন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বারবার ভূমিকম্প না হওয়া পর্যন্ত কেয়ামত অনুষ্ঠিত হবে না।’ (বুখারি) ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ বলেন, এ ধরনের ভূমিকম্পের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের শাস্তি দিয়ে থাকেন। কাব আল আহবার বলেন, পৃথিবীতে যখন অন্যায় অনাচার-পাপাচার করা হয় তখন পৃথিবী ভূমিকম্পে আক্রান্ত হয়। আল্লাহর ভয়ে পৃথিবী কেঁপে ওঠে। ইমাম ইবনুল কায়িম বলেন, পাপাচারের প্রভাবে পৃথিবীতে ধস নামে, ভূমিকম্প হয় এবং জমিনের বরকত তুলে নেয়া হয়।
তাই আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশে ঘন ঘন ভূমিকম্প আমাদেরকে সতর্ক বার্তা প্রদান করে যে, আমরা যেন পাপাচারে লিপ্ত না হই। আল্লাহমুখী হই। তাওবার মাধ্যমে আল্লার শাস্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমীন
আল্লাহ ভূমিকম্প দেন মানুষের শক্তির অহংকারকে চূর্ণ করে দিতে
মুফতি মানসুর আহমাদ
মুহতামিম, জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালাম
ভূমিকম্প—মাত্র কয়েক সেকেন্ডের এক কাঁপুনি। অথচ এই কাঁপুনিতে আধুনিক সভ্যতার অগণিত আয়োজন মুহূর্তেই ভেঙে চূর্ণ হয়ে যেতে পারে। মানুষের শক্তি, সামর্থ্য, প্রযুক্তি—সবই তখন অসহায়। কেন এমন হয়? আসলে এ ঘটনাগুলো কেবল ভূ-বিজ্ঞানের বিশ্লেষণে সীমাবদ্ধ নয়; এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে গভীর এক বার্তা।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি নিদর্শনসমূহ (বিপর্যয়) শুধু ভীতি প্রদর্শনের জন্যই পাঠাই।’ (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত : ৫৯) সুতরাং বিশ্বাস করতে হবে ভূমিকম্পসহ প্রতিটি বিপর্যয় আসে আল্লাহর তরফ থেকে মানুষের শক্তির অহংকারকে চূর্ণ করে দিতে। গাফলতের নিদ ভেঙে তার অন্তরে ঈমানের আলো জ্বালিয়ে দিতে।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা যখন এ ধরনের ঘটনা দেখবে, তখন আল্লাহর স্মরণ, দোয়া ও ইস্তিগফারের দিকে দ্রুত ফিরে যাও।’ (বুখারি, হাদীস : ১০৫৯) এ হাদিস প্রমাণ করে—ভূমিকম্প আমাদের আতঙ্কিত করার জন্য নয়; বরং আমাদের হৃদয়কে কোমল করার জন্য। আল্লাহ চান আমরা যেন একটু ভাবি; আমরা কী করছি? কার কাছে ফিরে যেতে হবে?
ভূমিকম্প আমাদের আমাদের বেশকিছু শিক্ষা দেয়—
১. আল্লাহর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা।
যে ভূমিকে সবচেয়ে নিরাপদ ভাবি, তা-ই যখন কেঁপে ওঠে, তখন বোঝা যায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কেবল আল্লাহর হাতে এবং প্রকৃত নিরাপত্তা কেবল তাঁরই কাছে।
২. গুনাহ পরিত্যাগের আহ্বান।
সব রকম গোনাহ ও পাপাচার যেহেতু এসব বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ, তাই এসব পরিত্যাগ করে ফিরে আসতে হবে।
৩. তাওবা, ইস্তিগফার ও দোয়ার জরুরি প্রয়োজন।
এমন মুহূর্তে আল্লাহই একমাত্র আশ্রয়। তাই তাওবা ইস্তিগফার ও দোয়ার মাধ্যমে তাঁর দিকে ধাবিত হতে হবে।
৪. আখিরাতের ভয়াবহতার ক্ষুদ্র ইঙ্গিত।
যে দৃশ্য মানুষের হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়—কিয়ামতের ভয়াবহতা এর তুলনায় কত বেশি ভয়ংকর হবে! এই ইঙ্গিত হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হবে।
সুতরাং ভূমিকম্প কোনো সাধারণ কম্পন নয়; এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে হৃদয় জাগিয়ে তোলার এক বিশেষ আহ্বান— ‘ফিরে এসো তোমার রবের কাছে, তিনিই তোমার নিরাপত্তা, শান্তি ও মুক্তির একমাত্র ঠিকানা।’
পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর আনুগত্য করতে হবে
মুফতি রেজাউল হক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ
মুহতামিম, জিয়াউল উলুম মাদরাসা, ঢাকা
ভূমিকম্প সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কেননা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ফলে মানুষ সাধ্যমতো আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। তাই আত্মরক্ষামূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব নয় না।
পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জনপদের অধিবাসীরা কি এতই নিঃশঙ্ক হয়ে গেছে যে আমার আযাব (নিঝুম) রাতে তাদের কাছে আসবে না, যখন তারা (গভীর) ঘুমে (বিভোর হয়ে) থাকবে!’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৯৭)
যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কোরআনুল কারীমে বান্দার পাপাচার ও অপরাধের অশুভ পরিণতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমারা যে বিপদ-মুসিবতে আক্রান্ত হও তা তোমাদের নিজ হাতের উপার্জন (কৃতকর্মের কারণে হয়ে থাকে), আর তিনি তোমাদের অনেক কিছুই ক্ষমা করে দেন। (সূরা শূরা, আয়াত : ৩০)
ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ভীতি প্রদর্শন করেন। আল্লাহ তায়ালার অবাধ্যতা ছেড়ে যেন তারা আল্লাহর অভিমুখী হয়। আল্লাহ তায়ালার অবাধ্যতা ত্যাগ করে এবং পাপাচার পরিহার করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আযাবের) নিদর্শনগুলো পাঠাই।’ (সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত : ৫৯)
ভূমিকম্প হলো- কিয়ামতের অন্যতম পূর্বাভাস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কিয়ামত ততক্ষণ সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না ইলম উঠিয়ে নেয়া হয়, অধিক হারে ভূমিকম্প হয়, সময় সংকুচিত হয়ে যায়, ব্যভিচার ব্যাপক হয়।’ (সহীহ বুখারি, হাদীস : ১০৩৬)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘এই উম্মত ভূমিকম্প, চেহারা বিকৃতি এবং পাথর বর্ষণের আযাবের সম্মুখীন হবে, যখন গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের প্রসার ঘটবে এবং মদপান বেড়ে যাবে।’ (তিরমিযি, হাদীস : ২২১২)
কোরআনুল কারীমের একটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে যিলযাল বা ভূমিকম্প নামে। এছাড়াও ভূমিকম্প প্রসঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। কিয়ামতের সূচনা ভুমিকম্পের মাধ্যমে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ! নিজ প্রতিপালকের (ক্রোধকে) ভয় কর। জেনে রাখো! কিয়ামতের প্রকম্পন এক সাংঘাতিক জিনিস। যেদিন তোমরা তা দেখতে পাবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী সেই শিশুকে পর্যন্ত ভুলে যাবে যাকে সে দুধ পান করিয়েছে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত ঘটিয়ে ফেলবে আর মানুষকে তুমি এমন দেখবে, যেন তারা নেশাগ্রস্ত অথচ তারা নেশাগ্রস্ত নয়; বরং সেদিন আল্লাহর শাস্তি হবে অতি কঠিন। (সূরা হজ, আয়াত : ১-২)
ভূমিকম্পের কারণ
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, টেকটোনিক প্লেটের স্থানচ্যুতি, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ও গলিত লাভা উৎক্ষিপ্ত হওয়া, পৃথিবীর অভ্যন্তরে শিলাচ্যুতি, পাহাড়-পর্বত হতে বৃহৎ শিলাখণ্ডের পতন, ভূত্বক তাপ বিকিরণ করা, ভূগর্ভস্থ বাষ্পের প্রচণ্ড চাপ ইত্যাদি কারণে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।
তবে হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভূমিকম্পের বেশকিছু কারণ উল্লেখ করে বলেন, ‘যখন গনিমতের মাল ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হবে, আমানত লুটের মালে পরিণত হবে, যাকাত জরিমানা রূপে গণ্য হবে, পুরুষ তার স্ত্রীর আনুগত্য করবে এবং তার মায়ের অবাধ্য হবে, বন্ধুর সাথে সদ্ব্যবহার করা হবে কিন্তু পিতার সাথে দুর্ব্যবহার করা হবে, মসজিদে হট্টগোল করা হবে, নিকৃষ্টতম চরিত্রের লোক হবে তার সম্প্রদায়ের নেতা,... মদ পান করা হবে, রেশমি বস্ত্র পরিধান করা হবে, বাদ্যযন্ত্রগুলোর ব্যাপক প্রচলন হবে এবং উম্মতের শেষ জামানার লোকেরা তাদের পূর্ববর্তী লোকদের অভিসম্পদ করবে; তখন তোমরা একটি অগ্নিবায়ু, ভূমিকম্প, ভূমিধস, চেহারা বিকৃতি অথবা পাথর বর্ষণ রূপ আযাবের সুতো ছেঁড়া (তাসবিহ) দানার ন্যায় একটির পর একটি নিদর্শনগুলোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। (তিরমিযি, হাদীস : ২২০৯)
সুতরাং ভূমিকম্প হলে তাওবা করতে হবে, পাপাচার পরিহার করতে হবে, পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ আনুগত্য করতে হবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে তার রহমত, নিরাপত্তা ও অনুগ্রহ প্রাপ্তির জন্য দুআয় মগ্ন হতে হবে।
পাপ বর্জন ছাড়া ভূমিকম্পের মতো আযাব থেকে বাচার কোনো উপায় নেই
মাওলানা খালেদুজ্জামান
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া, ঢাকা ও বিভাগীয় সম্পাদক, মাসিক মদীনা
ভূমিকম্প মহান আল্লাহর অসীম কুদরতের একটি নিদর্শন। এর মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাদের স্মরণ করিয়ে দেন তার শক্তি ও ক্ষমতার কথা। স্মরণ করিয়ে দেন তাঁর বান্দাদের দুর্বলতা, হীনতা ও মুখাপেক্ষিতার কথা। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভূমিকম্প শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়; এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে পাপাচারে নিমজ্জিত মানব সম্প্রদায়ের প্রতি এক গভীর সতর্কবার্তা।
এ সময় মানুষের কর্তব্য হলো- দ্রুত তাওবা করা, আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করা, বেশি বেশি ইস্তেগফার পাঠ করা এবং আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকা।
ভূমিকম্পের প্রধান কারণ মানুষের অবাধ্যতা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের ওপর যত বিপদ আসে, তা তোমাদের নিজেদের কর্মফলের কারণে, আর আল্লাহ তোমাদের অনেক অপরাধ ক্ষমা করে দেন।’ (সুরা শূরা, আয়াত : ৩০)
হাদীসে পাকে রাসূলুল্লাহ সা: সতর্ক করে বলেছেন, ‘এই উম্মতের মধ্যে যখন গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের প্রসার ঘটবে এবং মদ্যপান বেড়ে যাবে তখন তারা ভূমিকম্প, চেহারা বিকৃতি এবং প্রস্তরবৃষ্টির সম্মুখীন হবে।’ (তিরমিযী, হাদীস : ২২১২)
এছাড়াও কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে ভূমিকম্প ঘন ঘন ঘটার বিবরণও পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো। নিশ্চয়ই কেয়ামতের ভূকম্পন হবে ভয়াবহ।’ (সুরা হজ, আয়াত : ১-২)
হাদিসে ভূমিকম্পের কারণ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে, অবৈধ সম্পদ অর্জন, আমানতের খিয়ানত, যাকাতকে জরিমানা মনে করা, ধর্মহীন শিক্ষা, আত্মীয়তার অবহেলা, মসজিদে অশালীন কথাবার্তা, অযোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্ব ইত্যাদি। (তিরমিযী, হাদীস : ১৪৪৭)
পবিত্র কোরআন ও হাদীসের বহু নির্দেশনা অনুযায়ী বর্তমানের ভূমিকম্পগুলো কেবল ভূগর্ভস্থ প্লেট সরে যাওয়ার কারণে নয়; এগুলো মানুষের পাপাচার ও অবাধ্যতার জন্য আল্লাহর পাঠানো সতর্কবার্তা। পাপ বর্জন ছাড়া ভূমিকম্পের মতো আযাব থেকে বাচার কোনো উপায় নেই।
ভূমিকম্প মানুষের অসহায়ত্ব এবং আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ
মাওলানা যুবায়ের আহমাদ
কলামিস্ট ও শিক্ষক; খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ, গাজীপুর
আল্লাহ তায়ালা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। সাথে সাথে মানুষকে চলার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ যখন সীমালঙ্ঘন করে, আল্লাহ তাদের নানাভাবে সতর্ক করেন। ভূমিকম্পও সতর্কীকরণের একটি মাধ্যম। আল্লাহ চাইলেই তো ধ্বংস করে দিতে পারতেন, কিন্তু তা করেননি। ‘ধাক্কা দিয়েছেন, রক্ষাও করেছেন।’ মূলত এটা সতর্কবার্তা।
ভূমিকম্প কিয়ামতের আলামতও। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবে না, যে পর্যন্ত না ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং খুনখারাবি বাড়বে, তোমাদের সম্পদ এতো বাড়বে যে, উপচে পড়বে। (বুখারি, হাদীস : ৯৭৯)
মানুষ দুনিয়া অর্জনে এমনভাবে মগ্ন হয়, যেন দুনিয়া তার স্থায়ী। আল্লাহ একটু ধাক্কা দিয়ে বোঝান, কিছুই স্থায়ী নয়, তিনি ছাড়া। মানুষ যেভাবে ভূমিকম্পে দোকানপাট এমনকি সন্তানকে ছেড়েও দৌড়ে বাঁচতে চেষ্টা করেছে, এভাবেই সব ছেড়ে চলে যাবে। কোনো কিছুই মূলত তার না।
ভূমিকম্প মানুষের অসহায়ত্ব এবং আল্লাহ রব্বুল আলামীনের অস্তিত্বের প্রমাণ। মানুষ জানমাল ক্ষমতার যতই বাহাদুরি করুক, সে যে কতটা অসহায়, তার প্রতি মূহূর্তের বেঁচে থাকা যে মহান আল্লাহর দয়ার ওপর নির্ভরশীল তা তিনি জানিয়ে দিলেন। মানুষের একমাত্র আশ্রয় আল্লাহ তায়ালা। সংবাদ পাঠরত অবস্থায় পাঠকসহ সবাই অবচেতনভাবেই আল্লাহকে ডেকে উঠল, তাঁরই কাছে সাহায্য চাইল। তিনিই একমাত্র রক্ষাকারী।
ভূমিকম্প ইঙ্গিত করছে, মানুষের গুনাহ বেড়ে গেছে। গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের প্রসারও ভূমিকম্পের কারণ হয়। এসব থেকেও সতর্ক থাকতে হবে। রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘এ উম্মত ভূমিকম্প, বিকৃতি এবং পাথরবর্ষণের মুখোমুখি হবে। একজন সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, কখন সেটা হবে হে আল্লাহ রাসূল? তিনি বলেন, যখন গায়িকা এবং বাদ্যযন্ত্রের প্রকাশ ঘটবে এবং মদপানে সয়লাব হবে।’ (তিরমিযী, হাদীস : ২২১২)
ভূমিকম্প পাপ ছেড়ে পুণ্যের পথ ধরার সতর্কবার্তা
মুফতি আলী হাসান উসামা
খতিব, বাইতুস সালাত জামে মসজিদ, বেনারসি পল্লী, মিরপুর-১০, ঢাকা
এমনই এক শুক্রবারে ভূমিতে মহাকম্পন হবে, সেদিন গোটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে সকলে দণ্ডায়মান হবে মহান রাব্বুল আলামীনের সামনে। কিয়ামতের নিদর্শনগুলোর মধ্যে ভূমিকম্পের আধিক্য অন্যতম। রাসুলুল্লাহ সা: বলেন, ‘কিয়ামত হবে না, যতদিন না ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে এবং ভূমিকম্প বৃদ্ধি পাবে...।’ (বুখারী, হাদীস : ১০৩৬)
এই ক্ষুদ্র ভূমিকম্পগুলো কিয়ামতের বৃহৎ ভূমিকম্পের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ, নিজ প্রতিপালকের (ক্রোধকে) ভয় করো। জেনে রেখো, কিয়ামতের প্রকম্পন এক সাংঘাতিক জিনিস। যে দিন তোমরা তা দেখতে পাবে, সে দিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী সেই শিশুকে (পর্যন্ত) ভুলে যাবে, যাকে সে দুধ পান করিয়েছে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত ঘটিয়ে ফেলবে আর মানুষকে তুমি এমন দেখবে, যেন তারা নেশাগ্রস্ত, অথচ তারা নেশাগ্রস্ত নয়; বরং (সে দিন) আল্লাহর শাস্তি হবে অতি কঠোর।’ (সূরা হজ, আয়াত : ১-২) যখন ইসরাফিল আ: শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেবেন, তখন গোটা পৃথিবী চরমভাবে কেঁপে উঠবে। ‘যখন পৃথিবী তার প্রবল কম্পনে কম্পিত হবে।’ (সূরা যিলযাল, আয়াত : ১)
আজ ঢাকাশহরে যে মাত্রার ভূমিকম্প হলো, বহুতল ভবনের ছাদগুলো যেভাবে কেঁপে উঠল, মানুষ যেভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল, এগুলো কিন্তু এ বার্তাই দেয়, মৃত্যুর প্রস্তুতিতে আমাদের চরম ঘাটতি রয়ে গেছে। আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই ভীষণভাবে। অথচ মৃত্যুই আমাদের সকলের অনিবার্য পরিণতি। সুতরাং ‘ঈমানদারদের এখনো কি সময় হয়নি যে, তাদের অন্তর বিগলিত হবে আল্লাহর স্মরণে?’ (সূরা হাদিদ, আয়াত : ১৬) ‘হে মানুষ, তোমাকে তোমার মহানুভব রবের ব্যাপারে কোন জিনিস ধোঁকায় ফেলে রাখল?’ (সূরা ইনফিতার, আয়াত : ৬) ‘সুতরাং (পাপ ছেড়ে) পলায়ন করো আল্লাহর দিকে।’ (সূরা যারিয়াত, আয়াত : ৫০)
সুতরাং আসুন, শিক্ষাগ্রহণ করি। নতুনভাবে জীবন গড়ি। পাপ ছেড়ে পুণ্যের পথ ধরি। অন্যথায় না জানি কখন অপ্রস্তুত অবস্থায় জীবনে নেমে আসবে অনিবার্য পরিণতি ও ঘন ঘোর আঁধার।