দেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক সংকট চলছে, তার মূলে রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল। সবার মতামত উপেক্ষা করে ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাই এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আর এই সিদ্ধান্ত আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে বাস্তবায়ন করেছেন আপিল বিভাগের চার বিচারপতি। সাত সদস্যবিশিষ্ট আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ৪ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে রায় দেন। এর মধ্যে রয়েছেন-তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, এসকে সিনহা চৌধুরী এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সিনিয়র ৮ জন আইনজীবীকে নিয়ে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) গঠন করেছিল আদালত। তাদের মধ্যে ৭ জন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মতামত দেন। বহাল রাখার পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও। এছাড়া এই ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নিতে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করেছিল সরকার। ওই কমিটি প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে সুপারিশ করেছিল। পরে তারা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে সুপারিশ পালটে দেয়। এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল না হলে দেশে আজকের এই সংকট তৈরি হতো না। তার মতে, নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠাতে এই ব্যবস্থা বাতিলের আয়োজন করা হয়।
জানা গেছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে ত্রয়োদশ সংশোধনীতে সংবিধানে ৫৮ক, ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ ও ৫৮ঙ অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়। এরপর এই ব্যবস্থার অধীনে তিনটি নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন এই ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনে প্রথম আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এছাড়া এই ব্যবস্থার অধীনে পরবর্তী দুটি নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনরা পরাজিত হয়েছিল। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এই নির্বাচন। কিন্তু ২০১১ সালে আদালত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। এরপর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধান থেকে বাদ পড়ে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা। পরে যে তিনটি নির্বাচন হয়েছে, তার সবগুলোর বিতর্কিত। ২০১৪ সালে নির্বাচন হয়, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ২০১৮ সালে রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কারণেই রাজনৈতিক সংকটে পরে দেশ।
আদালতে রিট : ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এম সলিমউল্লাহসহ অন্যরা ১৯৯৯ সালে রিট আবেদন করেন। হাইকোর্টের তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন। তাতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে আপিল করা হয়। আপিলের শুনানি শেষে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে (৪:৩) ২০১১ সালের ১০ মে রায় দেন। এতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানপরিপন্থি ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। রায়ে বিচাপতিদের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে ছিলেন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, এসকে সিনহা চৌধুরী এবং সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। বাতিলের বিপক্ষে ছিলেন আবদুল ওহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা এবং মোহাম্মদ ঈমান আলী। এমিকাস কিউরিদের মতামত উপেক্ষা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের মতামতের ভিত্তিতে এই ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত। এরপর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা হয়। তবে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছিলেন, আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। কিন্তু সরকার তা আমলে নেয়নি। ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। তবে তা প্রকাশের আগেই ২০১১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে।
অ্যামিকাস কিউরিদের মতামত উপেক্ষা : ইস্যুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই মামলায় সিনিয়র ৮ জন আইনজীবীকে নিয়ে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) গঠন করে সরকার। তাদের মধ্যে ৭ জন তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মতামত দেন। আবার এর মধ্যে ৫ জন ওই ব্যবস্থা রাখা, দুই সংস্কারের পক্ষে এবং ১ জন বাতিলের পক্ষে মত দেন। যারা ওই ব্যবস্থা হুবহু রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন তারা হলেন ড. কামাল হোসেন, টিএইচ খান, মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম এবং ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। তাদের যুক্তি ছিল, এই ব্যবস্থাটি জনগণের আন্দোলনের ফসল। এছাড়া এটি একটি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া। সংস্কারের পক্ষে যারা মত দিয়েছিলেন তারা হলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এবং ড. এম জহির। অন্যদিকে ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করে তা বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এমনকি তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন : ইস্যুতে ২০১০ সালের ২১ জুলাই ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কমিটির চেয়ারপারসন ছিলেন প্রয়াত সংসদ সদস্য সাজেদা চৌধুরী এবং কো-চেয়ারম্যান প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আমির হোসেন আমু, প্রয়াত মো. আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, প্রয়াত মো. রহমত আলী, প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, প্রয়াত মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, রাশেদ খান মেনন, প্রয়াত আবদুল মতিন খসরু, হাসানুল হক ইনু, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, হাছান মাহমুদ ও শিরীন শারমিন চৌধুরী। প্রধান বিরোধী দল হিসাবে বিএনপিকে একজন প্রতিনিধির নাম দেওয়ার আহ্বান জানানো হলে তাতে তারা সাড়া দেয়নি। দশ মাসে কমিটি ২৬টি বৈঠক করে। এতে ১১৪ জন ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানালে ১০৪ জন বৈঠকে অংশ নেন। কমিটি ২০১১ সালের ২৯ মে বিশেষ সংসদীয় কমিটি সংবিধানের ৪৩টি অনুচ্ছেদে মোট ৪৯টি ক্ষেত্রে পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি সংশোধিত সুপারিশমালা তৈরি করে। সেখানে তিন মাস সময় বেঁধে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অনির্দিষ্টকালের জন্য বহাল রেখে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়। এর পরদিন ৩০ মে বিশেষ কমিটির সদস্যরা শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাতের পর শেখ হাসিনার একার নির্দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দিয়ে এবং সংসদ বহাল রেখে পরবর্তী নির্বাচনের বিধান অন্তর্ভুক্ত করে ৫ জুন কমিটি তাদের সুপারিশ চূড়ান্ত করে।