ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে চার ধাপে ৪৭টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এখনো পর্যন্ত জাতীয় পার্টি-জাপাসহ সাতটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে সংলাপে ডাকা হয়নি। তবে দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা নেই বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। অন্যদিকে ইসির সংলাপে অংশ নিয়ে জোটবদ্ধ প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারা এবং নির্বাচনি প্রচারণায় পোস্টার না থাকায় তীব্র আপত্তি জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা ছাড়াই এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইসির ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে জোটবদ্ধ প্রতীকে নির্বাচনের এবং পোস্টার ব্যবহারের বিধানটি তুলে দেওয়া হয়। কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনী প্রস্তাব সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো আপত্তি জানিয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেগুলোর পরিবর্তনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি আরো বলেন, যে দলগুলোকে এখনো সংলাপে ডাকা হয়নি তারা যদি ভোট দিতে পারেন তাহলে অবশ্যই নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। প্রার্থী হতে কোনো বাধা নেই।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ নভেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ শুরু করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। চারধাপে ৪৯টি রাজনৈতিক দলকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি এবং তৃণমূল বিএনপি সংলাপে অংশগ্রহণ করেনি। এখনো পর্যন্ত ইসির নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫৭টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন কার্যক্রম স্থগিত আছে। ৫ আগস্টের পর জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের জোট শরিকে থাকা ছয়টি দল নিয়ে বর্তমানে রাজনীতির মাঠে চলছে সমালোচনা ও বিতর্ক। এ সমালোচনা ও বিতর্ক থেকে ইসিকে দূরে রাখতেই ৭টি দলকে সংলাপে না ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। যে সাত দল এবার আমন্ত্রণ পায়নি সেগুলো হলো-জাতীয় পার্টি-জেপি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম.এল), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, জাতীয় পার্টি-জাপা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ ও বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন।
ইসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জামায়াতের নেতৃত্বে কয়েকটি ইসলামী দল, এনসিপি এবং গণঅধিকার পরিষদের আপত্তির কারণে দলগুলোকে সংলাপে ডাকা হয়নি। তবে সংলাপে ডাকা না হলেও ঐসব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার আইনগত কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচনের আগে যদি ঐসব দলের রাজনৈতিক কার্যক্রমের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকে তাহলে অবশ্যই তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
জোটবদ্ধ প্রতীক ও পোস্টার বাদ নিয়ে আপত্তি : সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলো বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে একতরফাভাবে আরপিও সংশোধন করেছে ইসি। ইতিপূর্বে আরপিও সংশোধনের পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করত এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটির যাচাই-বাছাই শেষে সংসদে বিতর্কের পর আরপিও সংশোধন আইন পাশ হতো। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট জোট এক প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর যত জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে সব নির্বাচনেই জোটবদ্ধভাবে রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করেছে। ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনেও নিবন্ধন স্থগিত থাকা জামায়াতে ইসলামী বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। বিএনপি ও তাদের সমমনা ছোট দলগুলোর নেতারা মনে করেন, একটি বিশেষ দলকে ভোটে সুবিধা করে দিতে সরকার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ২০ (১) ধারার সংশোধনী এনেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরপিও সংশোধন একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত। আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত এটি যেহেতু গণঅভ্যুত্থানের সরকার সেহেতু রাজনৈতিক ঐকমত্যে ছাড়া নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার এই সরকারের নেই। এই ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তাদের অভিযোগ, কারো ইঙ্গিতে ইসি এটি করেছে। তারা এতে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন।
দলগুলো বলছে, জোটগত নির্বাচন করলেও নিজস্ব প্রতীকে ভোট করে ছোট দলগুলোর নেতাদের জয় সহজ হবে না। এর ফলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সুফল পেয়ে যেতে পারে। তাই বিএনপি আরপিওর ঐ সংশোধনী বাতিল চেয়েছে। জোটবদ্ধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছোট দলগুলো তাদের পছন্দমতো দলীয় অথবা জোটের বড় শরিক দলের প্রতীকে ভোট করার অধিকার চায়—যা আগে ছিল।
ইসির সংলাপে অংশ নিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি এ প্রসঙ্গে বলেন, জোটের প্রতীক নিয়ে বাধা রাখা সমীচীন নয়। অনেকে নিজস্ব প্রতীকে ভোট করবেন। আবার জোটগতভাবে নির্বাচন করলে অন্য দলের প্রতীকে ভোট করার সুযোগও রাখা দরকার।
এদিকে ‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা-২০২৫’ নামে যে নতুন আচরণবিধি করা হয়েছে সেখানে নির্বাচনি প্রচারণায় পোস্টার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।