ওঠা-নামার পথ বা র্যাম্প ছাড়াই প্রায় এক বছর আগে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। কথা ছিলো দ্রুত সময়ের মধ্যে র্যাম্প নির্মাণ শেষ করা হবে। তবে নয়টি র্যাম্পের আটটির নির্মাণকাজ এখনো শেষ করতে পারেনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ। ফলে নির্মাণকাজের ধীরগতির কারণে একদিকে যেমন জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে অন্যদিকে ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকার এই মেগাপ্রকল্পের সুফলও মিলছে না। ওঠা-নামার সুযোগ না থাকায় হাতে গোনা কিছু যানবাহন চলছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই এক্সপ্রেসওয়েতে।
বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামের প্রধান সড়কের বন্দর, ইপিজেড, ব্যারিস্টার কলেজ ও স্টিলমিল এলাকায় র্যাম্পের জন্য খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সড়কটি যান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর, সবচেয়ে বড় ইপিজেড চট্টগ্রাম ইপিজেড, কর্ণফুলী ইপিজেড এবং পতেঙ্গা এলাকায় গড়ে ওঠা বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলোকে ঘিরে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে নিত্য যানজট হচ্ছে। তাতে জনদুর্ভোগের পাশাপাশি দেশের সার্বিক আমদানি-রফতানি কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
দুটি ইপিজেডের ছয় লাখ শ্রমিকসহ নগরীর বন্দর-পতেঙ্গা এলাকার লাখ লাখ বাসিন্দাকে সীমাহীন দুর্ভোগ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। থমকে গেছে ওই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য। সড়কে বড় বড় গর্ত ডোবার আকার নিয়েছে। বৃষ্টি না হলেও নালা-নর্দমা থেকে আসা পানিতে পুরো সড়কে কাদায় মাখামাখি। লাখো শ্রমিক সেই কাদা পানি মাড়িয়ে পথ চলতে বাধ্য হচ্ছে। সড়কের গর্তে আটকে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে।
যানজটে আকটা পড়ছে হাজার হাজার যানবাহন। কখনো কখনো ওই যানজট সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত স্থায়ী হচ্ছে। কবে নাগাদ এই দুর্ভোগের অবসান হবে তা খোদ সিডিএর কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। তিন দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। তবে কাজের যে গতি তাতে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আবার আরো এক দফা প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজনের কথা বলছে সিডিএ।
বিগত ২০১৭ সালে অনুমোদন হওয়া এই প্রকল্পের কাজ আট বছরেও পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি সিডিএ। ২০১৯ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত শুধু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল অংশের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ওঠানামার জন্য ১৫টি র্যাম্প নির্মাণ করার কথা। তবে সরকার পরিবর্তনের পর ছয়টি র্যাম্প বাদ দেওয়া হয়েছে। বাকি নয়টির মধ্যে একটির কাজ শেষ হয়েছে, অন্য আটটির কাজ চলমান রয়েছে। এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে চার হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নির্মিত এই এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে উদ্বোধন হলেও তখন গাড়ি চলাচল শুরু হয়নি। হাসিনার পতনের পর গত বছরের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে পরীক্ষামূলকভাবে গাড়ি চলাচল শুরু হয়। এরপর চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। মোট ১০ ধরনের গাড়ি চলাচলের সুযোগ রেখে টোলের হার চূড়ান্ত করা হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল এবং ট্রেইলার ওঠা-নামার সুযোগ রাখা হয়নি। তবে র্যাম্প না থাকায় এক্সপ্রেসওয়েতে পর্যাপ্ত যানবাহন চলছে না। বিমানবন্দর এবং পতেঙ্গা সৈকতগামী কিছু যানবাহন ছাড়া এক্সপ্রেসওয়ে খালি পড়ে থাকছে। অথচ সড়কে তীব্রজটে অচলাবস্থা।
প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে করা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ২০২৫ সালে প্রতিদিন গড়ে ৬৬ হাজার ৩২৩টি গাড়ি চলাচল করবে। সবচেয়ে বেশি ৩৯ হাজার কার ও তিন চাকার অটোরিকশা চলার কথা। বর্তমানে দিনে গড়ে গাড়ি চলাচল করছে ৭ হাজারেরও কম।
এই প্রকল্পে ১০টি র্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে পতেঙ্গামুখী অংশের আগ্রাবাদ জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সামনে নামার র্যাম্প এবং আগ্রাবাদে ডেবার পাড়ে পতেঙ্গামুখী ওঠার র্যাম্প দুটির কাজ এখনো শুরুই হয়নি। তবে এটি বাদ দিয়ে বাকি নয়টির কাজ শেষ করতে চাইছে সিডিএ। পতেঙ্গা থেকে লালখান বাজারমুখী অংশে নিমতলা মোড়ে নামা-ওঠার দুটি র্যাম্প, টাইগারপাসে আমবাগানমুখী নামার একটি র্যাম্প এবং লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গামুখী অংশে ফকিরহাটে নামার একটি র্যাম্পের কাজ শেষ পর্যায়ে। তবে এগুলো দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়নি। বাকি ৪টির কাজ চলমান। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ইপিজেডের সামনে দুই অংশে ওঠা-নামার দুটি, কর্ণফুলী ইপিজেডের সামনে ওঠার একটি এবং জিইসি মোড়ে পতেঙ্গামুখী একটি ওঠার র্যাম্পের নির্মাণকাজ। চট্টগ্রাম ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেড এলাকার র্যাম্প নির্মাণকাজ ধীরগতিতে চলছে। ব্যারিস্টার কলেজ এলাকার র্যাম্প নির্মাণেও গতি নেই। এই কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ির ফলে মাইলের মাথা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম ইপিজেড এবং কর্ণফুলী ইপিজেড এলাকায় সড়কের বেহাল দশা। সেখানে নিত্য যানজট হচ্ছে। প্রকল্পের অংশ হিসাবে আগ্রাবাদ এলাকায় নর্দমা সম্প্রসারণ কাজ চলছে। এই সড়কেও এখন চলছে খোঁড়াখুঁড়ি।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শুধু লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা যাওয়ার জন্য নয়, পুরো নগরীর যানজট কমানোর জন্য করা হয়েছে। নকশা অনুযায়ী র্যাম্পগুলো না থাকলে মানুষ সুফল পাবে না। প্রত্যাশা অনুযায়ী গাড়ি চলাচল করবে না, তাতে নগরীতে যানজটও কমবে না। তারা বলছেন, এক্সপ্রেওয়েকে অধিকতর ব্যবহার উপযোগী করতে হলে শুধু র্যাম্প চালু করলেই হবে না, এজন্য ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট লাগবে। সিডিএর কর্মকর্তারা বলছেন, দ্রুত র্যাম্প নির্মাণকাজ শেষ করা হবে।