ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটির ব্যয় বেড়েই যাচ্ছে। ১৭ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প এখন স্থবির হয়ে আছে। কাজের অগ্রগতি নেই। সাড়ে ৪৫ কিলোমিটার জমি অধিগ্রহণে ৪ বছরে অগ্রগতি মাত্র ২১ শতাংশ। এ কারণে প্রকল্পের মেয়াদ আবারও বাড়বে। চলমান এই মহাসড়কে ২০৯ কিলোমিটার সংস্কারহীন খানাখন্দে মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, চীনের অর্থায়নে প্রকল্পটির মূল সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিস্তারিত নকশা ২০১৪-১৫ সালে চূড়ান্ত হয়। ওই সমীক্ষায় বিদ্যমান দুই লেনের সড়কটিকে উন্নীত করে চার লেন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ ছাড়া উভয়পাশে ৩ দশমিক ৬ মিটার প্রশস্ত সার্ভিস সড়ক নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছিল। পরে চীনা অর্থায়ন বাতিল করে বর্তমানে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার যৌথ অর্থায়নে চার লেন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটি নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ইন্টারসেকশন থেকে শুরু হয়ে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটসহ ৭ জেলার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে ভারত সীমান্তবর্তী তামাবিল যাবে। সড়কটির দৈর্ঘ্য ২১০ কিলোমিটার। সিলেট শহরের পীর হাবিবুর রহমান চত্বরে ঢাকা-সিলেট অংশ শেষ হয়েছে। এরপর ওই চত্বর থেকে সার্ক হাইওয়ে করিডরের আওতায় তামাবিল গিয়ে শেষ হবে। সিলেট পর্যন্ত এই সড়কের দৈর্ঘ্য ২০৯ কিলোমিটার। প্রকল্পের আওতায় উভয় পাশে সার্ভিস লেনসহ ৬ লেনে উন্নীত করতে ৬৬টি সেতু, ৩০৫টি কালভার্ট, ১৩টি ফ্লাইওভার/আন্ডারপাস, ২৬টি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে এ কাজ বাস্তবায়নে ১৩টি প্যাকেজে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু জমি বুঝিয়ে না দেওয়ায় কাজ প্রায় বন্ধ আছে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কটি এশিয়ান হাইওয়ে (এএইচ-১ এবং এএইচ-২), বিমসটেক করিডর (করিডর-৩) এবং সার্ক হাইওয়ে করিডর (এসএইচসি-৫) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ বিশেষ করে ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান এবং চীনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বিদ্যমান দুই লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কটি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছিল। ২০০৩-০৪ সালে যান চলাচলের জন্য সড়কটি উন্মুক্ত করা হয়। মহাসড়কটি চালু হওয়ার পর এ করিডরকেন্দ্রিক শিল্প-কারখানা, ব্যবসা, পর্যটন ইত্যাদির দ্রুত বিকাশ ঘটায় এতে যানবাহনের সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। ফলে এ মহাসড়কে ভ্রমণ সময় বৃদ্ধিসহ সড়ক দুর্ঘটনাও বেড়ে যায়। মহাসড়কের বিভিন্ন ইন্টারসেকশন ও বাজার এলাকাগুলোতে প্রতিনিয়ত যানজট সৃষ্টি হয়। প্রায় ২০ বছর আগে ঢাকা থেকে সিলেট পর্যন্ত ৪-৫ ঘণ্টায় ভ্রমণ করা গেলেও বর্তমানে ৭-৮ ঘণ্টা সময় লাগে। মাঝে মধ্যে ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। তাছাড়া এ মহাসড়কের দুপাশে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ অসংখ্য স্থান রয়েছে। সড়কটি উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগের প্রধান করিডর। এ কারণে এ মহাসড়কের নিরাপত্তা উন্নয়নসহ একে যথাযথ মানে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ অবস্থায় ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত একনেক সভায় ‘সাসেক ঢাকা-সিলেট করিডর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প’ শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। ব্যয় ধরা হয় ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে ৩ হাজার ৬৭৩ কোটি এবং এডিবি থেকে ঋণ নেবে ১৩ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ দিয়ে প্রকল্পটির প্রশাসনিক আদেশ জারি করা হয়।
সওজের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, অধিকাংশ প্রকল্প বাস্তবায়নে সাধারণত ভূমি অধিগ্রহণের কারণে ইউটিলিটি শিফটিং কাজে বিলম্ব হয়। বিষয়টি মাথায় রেখেই চলমান এই প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে তৎকালীন সরকার ২০১৫ সালে প্রণীত ডিজাইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি শিফটিং কাজ শেষ করার উদ্যোগ নেয়। যাতে ভূমি অধিগ্রহণের কারণে প্রকল্পের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত না হয়। সে অনুযায়ী ২০১৮ সালে ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি স্থানান্তরে প্রকল্পটি ৩ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকায় অনুমোদিত হয়। সে অনুযায়ী ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। কিন্তু এ প্রকল্পের উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে এডিবি নির্বাচিত হওয়ার পর উন্নয়ন সহযোগীর শর্ত মোতাবেক ২০২০ সালে পুনরায় ডিজাইন রিভিউ করা হয়। ২০১৫ সালের ডিজাইন অনুযায়ী সার্ভিস লেনের প্রশস্ততা ছিল ৩ দশমিক ৬ মিটার। এরপর ২০২০ সালে এডিবি যুক্ত হওয়ার পর সার্ভিস লেন ৫ দশমিক ৫ মিটার করা হয়। এ কারণে ডিজাইন কিছুটা পরিবর্তিত হয়। সড়কের প্রশস্ততা বেড়ে যাওয়ায় ভূমি অধিগ্রহণও সংশোধন করা হয়। সংশোধিত ডিপিপিটি ২০২১ সালে একনেক সভায় অনুমোদিত এবং ১ম সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী এ প্রকল্পের ব্যয় ৭ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা করা হয়। মেয়াদ ধরা হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। পরে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০২১ সালে সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদনের পর নতুনভাবে ভূমি অধিগ্রহণ প্ল্যান অনুসারে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে এলএ প্রস্তাব পুনর্দাখিল করা হয়। প্রকল্পটির আওতায় ঢাকা-সিলেট অংশে ৭টি জেলায় ৬৬টি এলএ কেসের মাধ্যমে ৮ একর ৩০ শতক জমি অধিগ্রহণের সংস্থান রাখা হয়েছে। এই ৬৬টি এলএ কেসের মধ্যে মাত্র ৮টির দখল হস্তান্তর হয়েছে। চার বছরে এই প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১৫ শতাংশ।
নারায়ণগঞ্জ জেলার ৪টি এলএ (ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন) কেসের ভূমি অধিগ্রহণ প্রস্তাব ২০২১ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে দাখিল করা হলেও এ পর্যন্ত ৩টি এলএ কেসের দখল হস্তান্তর হয়েছে। নরসিংদী জেলায় ৮টি ভূমি অধিগ্রহণ প্রস্তাব পাঠানো হয় ২০২১-২২ সালের ডিসেম্বরে। এ পর্যন্ত ৩টি এলএ কেসের দখল হস্তান্তর করা হয়। কিশোরগঞ্জ জেলায় ১টি এলএ প্রস্তাব ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে দাখিল করা হলেও অদ্যাবধি এর ৭ ধারা নোটিশ জারি করা হয়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তিনটি এলএ প্রস্তাবের মধ্যে ২টির দখল হস্তান্তর পাওয়া যায়। হবিগঞ্জ জেলায় মোট ৩০টি এলএ প্রস্তাব পাঠানো হয় ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। এ পর্যন্ত ১টি মাত্র এলএ কেসের দখল হস্তান্তর হয়। সিলেট জেলায় ঢাকা-সিলেট অংশে ২০২১ ও ২০২২ সালে ১৭টি এলএ প্রস্তাব দাখিল করা হয়। অথচ সেখান থেকে একটিও দখল হস্তান্তর পাওয়া যায়নি। এমনকি কোনো প্রাক্কলনও পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, ইউটিলিটি শিফটিং কাজটি ভূমি অধিগ্রহণের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। ভূমি অধিগ্রহণ বিলম্বিত হওয়ার কারণে ইউটিলিটি শিফটিং কাজটিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রকল্পে এডিবির শর্তানুসারে ঋণ চুক্তি সম্পাদনের আগেই দরপত্র আহ্বানের বাধ্যবাধকতা ছিল। অতঃপর পর্যায়ক্রমে এ প্রকল্পের সবকটি লটের দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তির শর্তানুসারে কার্যাদেশ দেওয়ার ২৭০ দিনের মধ্যে ঠিকাদারকে জমি বুঝিয়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো ঠিকাদারকে সম্পূর্ণ জমি বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ১৩টি নির্মাণ চুক্তির মাধ্যমে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি শিফটিং কাজ বিলম্বিত হওয়ায় মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হচ্ছে না। চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঠিকাদারকে জমি বুঝিয়ে দিতে না পারায় কাজ বাস্তবায়ন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঠিকাদাররা জনবল, যন্ত্রপাতি ও মালামাল সরবরাহ করলেও কাজের সাইট বুঝে না পাওয়ায় কাজ করতে পারছেন না। এ পর্যন্ত এ প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি প্রায় ১৫.৩০%।
সরেজমিন দেখা গেছে, বর্তমানে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অসংখ্য খানাখন্দ সৃষ্টি হয়ে বেহাল হয়ে পড়েছে। এ প্রকল্পটি অনুমোদনের আগের বছর থেকে বিগত ৫ বছর এ সড়কে কোনো বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করা হয়নি। এতে বিদ্যমান সড়কের পেভমেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। বিদ্যমান চুক্তির আওতায় প্রয়োজনীয় পরিমাণ মেরামত সম্পন্ন করে নির্বিঘ্নে যান চলাচল বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি শিফটিং বিলম্বের ফলে বিদ্যমান সড়ক কমপক্ষে আরও ২ বছর রক্ষণাবেক্ষণ করে রাখতে হবে।
ঢাকা-সিলেট রোডের নির্মাণ প্রকল্পের পিডি ও সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. ফজলুল করিম যুগান্তরকে বলেন, সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে ৬৬টি এলএ কেসের প্রস্তাব আছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৩টি এলএ কেস নিষ্পত্তি হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দরপত্রের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ১৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করতে প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু জমি বুঝে না পাওয়ার কারণে ঠিকাদাররা কাজ শুরু করতে পারছেন না। তিনি বলেন, ডিসেম্বর পর্যন্ত চলমান কাজের মেয়াদ আছে। নির্দিষ্ট সময়ে জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন না হলে অবশ্যই মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ শাখার পিডি সওজের সিলেট জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবু সাঈদ মো. নাজমুল হুদা বলেন, জমি অধিগ্রহণের সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এখন আগের চেয়ে জমি অধিগ্রহণের নথিপত্র দ্রুত নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এভাবে চলমান থাকলে বর্ধিত সময়ের মধ্যে অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।