Image description

ফুটবল অনুশীলনে ছিলেন ২৪ বছর বয়সী সীমা আখতার। তখন তার এক বন্ধু তাকে এসে একটি খবর দিলেন। বললেন, বাংলাদেশের পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর কাছে এটি ছিল ন্যায়বিচারের মুহূর্ত। 
গত বছর বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়ন চালান হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনী। এতে সীমা আখতারের কয়েকজন বন্ধু নিহত হন। যদিও একপর্যায়ে হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

৭৮ বছর বয়সী এই নেত্রীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কয়েক মাস ধরে চলা বিচারের পর হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। অভ্যুত্থানে ভয়াবহ দমন-পীড়নের নির্দেশদাতা হিসেবে হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে ট্রাইব্যুনাল।

ঢাকা থেকে সীমা আল জাজিরাকে বলেছেন, ফ্যাসিবাদী হাসিনা ভেবেছিলেন তাকে পরাজিত করা যাবে না। তিনি চিরকাল শাসন করতে পারবেন। হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া অভ্যুত্থানের শহীদদের পক্ষে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বড় পদক্ষেপ। তবে সীমা মনে করেন তাকে শুধু এই সাজা দেয়াই যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, আমরা তাকে ঢাকাতেই ফাঁসিতে ঝুলতে দেখতে চাই। যদিও এটা বাস্তবায়ন করা সহজ নয়। 

আপাতত হাসিনা ফাঁসির মঞ্চ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন। ২০২৪ সালের আগস্টে হাসিনার বাসভবনে হামলে পড়েন আন্দোলনকারীরা। তখন ঢাকা থেকে পালিয়ে দিল্লিতে আশ্রয় নেন তিনি। 

তাকে ফেরত পেতে ভারত সরকারের কাছে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। যা গত ১৫ মাসে দক্ষিণ এশিয়ার এ দু’টি দেশের মধ্যে উত্তেজনার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের আনুষ্ঠানিক রায় সেই উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 
ভারত আপাতত হাসিনা- উত্তর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী হলেও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, নয়াদিল্লি ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে না। ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, নয়াদিল্লি কীভাবে হাসিনাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে?

‘সম্পূর্ণ অবন্ধুসুলভ আচরণ’
সবচেয়ে বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব  দেয়া শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা। প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৯৬ সালে। ২০০১ সালে পরাজিত হন। ক্ষমতার বাইরে ছিলেন ২০০৯ সাল পর্যন্ত। এরপর পুনরায় নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা ধরে রাখেন টানা ১৫ বছর। এমন সব নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছেন যেখানে প্রায়ই বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতো বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। তার আমলে জোরপূর্বক গুম হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বহু মানুষ। নির্যাতনের ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। বিনা দোষে কারাগারে গিয়েছেন বিরোধী দলগুলোর অগণিত নেতাকর্মী। 

আর এসব কর্মকাণ্ড ঢাকতে অর্থনৈতিক সাফল্যের কথা বলে বেড়াতো হাসিনার সরকার। এই বাংলাদেশকে একসময় সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি  পেয়েছে, যা ভারতের মাথাপিছু আয়কেও ছাড়িয়ে গেছে।

প্রাথমিকভাবে গত বছরের জুলাই মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিদের জন্য সরকারি চাকরিতে থাকা কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। যা দমনে কঠোর দমন-পীড়নের পথ বেছে নেয় নিরাপত্তা বাহিনী। যা একসময় হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নৃশংসতা অভ্যুত্থানে প্রায় ১৪০০ মানুষ নিহত হয়েছেন।

গত বছরের ৫ই আগস্ট দেশ ছেড়ে নয়াদিল্লিতে পালিয়ে যান ভারতের দীর্ঘদিনের মিত্র শেখ হাসিনা। এরপর দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে ঢাকা-নয়াদিল্লির মধ্যে চাপ সৃষ্টির মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের দিকে ঝুঁকেছে বাংলাদেশ। 

মঙ্গলবার ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে কণ্ঠ আরও  জোরালো করেছে। ভারতের সঙ্গে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে ঢাকার। তা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো নয়াদিল্লির ‘বাধ্যতামূলক কর্তব্য’। পক্ষান্তরে হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেয়া অবন্ধুসুলভ আচরণ এবং ন্যায়বিচার অবজ্ঞার শামিল।

ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, প্রত্যর্পণ চুক্তিতে ব্যতিক্রমও রয়েছে। বিশেষ করে ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিদের’ জন্য। নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলেন, হাসিনার রায়টিকে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির প্রতিহিংসা হিসেবে বিবেচনা করছে ভারত। 

ভরদ্বাজ আল জাজিরাকে বলেন, নয়াদিল্লির দৃষ্টিতে বাংলাদেশ বর্তমানে ‘ভারত-বিরোধী শক্তি’ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ইউনূস প্রায়শই ভারতের সমালোচনা করেছেন। হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা আন্দোলনের নেতারা প্রায়শই তাকে সমর্থন দেয়ার জন্য নয়াদিল্লিকে দোষারোপ করেছেন। এই প্রেক্ষাপটে, হাসিনাকে হস্তান্তর করা মানে ভারত-বিরোধী শক্তির বৈধতা দেয়া।

‘ভারতের সমীকরণে পরিবর্তন জরুরি’
হাসিনার রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য হচ্ছে- তারা হাসিনার রায় আমলে নিয়েছে। এখন নয়াদিল্লি সকল স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করতে আগ্রহী। পাশাপাশি তারা বাংলাদেশের শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতাসহ জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের প্রতি সর্বদা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

তবু বর্তমানে নয়াদিল্লি-ঢাকার সম্পর্ক শীতল। হাসিনা আমলে এ দুই দেশের অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক মৈত্রীর সম্পর্ক এখন অবিশ্বাসে পরিপূর্ণ।
এমন পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার চক্রবর্তী। বলেছেন, ঢাকার বর্তমান সরকারের অধীনে সম্পর্ক বৈরী থাকবে। এর কারণ হাসিনার প্রত্যর্পণ ইস্যুতে তারা শেষ পর্যন্ত সরব থাকবে। তবে চক্রবর্তী মনে করেন, ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর নতুন করে সুযোগ তৈরি হতে পারে। হাসিনা-বিরোধী শক্তির মধ্যে নয়াদিল্লির কড়া সমালোচক বিএনপি থাকলেও নির্বাচিত প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করা ভারতের জন্য কিছুটা সহজ হবে। দুই প্রতিবেশীর এমন উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক প্রসঙ্গে চক্রবর্তী বলেন, আমরা এভাবে চলতে পারি না। ঢাকায় ভারতের জন্য নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ভারতের অপেক্ষা করা উচিত।

ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, হাসিনাকে নিয়ে ভারত একটি দ্বিধায় পড়েছে। তবে বাংলাদেশে তার অজনপ্রিয়তার বিষয়ে নয়াদিল্লি অন্ধ নয়। তিনি বলেন, সাধারণত নয়াদিল্লি ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় দেখতে চাইবে। হাসিনা বরাবরই ভারতের পছন্দের তালিকায়। দত্ত বলেন, তবে বাস্তবতা হলো- ভারতকে মেনে নিতে হবে যে, বাংলাদেশ সম্ভবত হাসিনাকে আর কোনো সুযোগ দেবে না। এর পরিবর্তে ভারতকে ঢাকার অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

এই পর্যবেক্ষক বলেন, ভারতের সেখানে অন্য কোনো স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কখনোই ভালো সমীকরণ ছিল না। কিন্তু এখন তা পরিবর্তন করতে হবে। তিনি আরও যোগ করেন, বর্তমানে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বেশ ভঙ্গুর পর্যায়ে আছে। তবে ভারতকে এই নির্দিষ্ট এজেন্ডা (হাসিনার প্রত্যর্পণ) থেকে আগানোর ক্ষেত্রে সক্ষম হতে হবে। দত্ত বলেন, ভারত এবং বাংলাদেশ আর মিত্র না থাকলেও তাদের একে-অপরের প্রতি সৌজন্যবোধ থাকা দরকার।

হাসিনাকে ধরে রাখার সুবিধা
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪০০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। চীন-এর পরে ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। উত্তেজনা সত্ত্বেও দুই দেশের বাণিজ্য সামপ্রতিক মাসগুলোতে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও ভারত দীর্ঘদিন ধরে জোর দিয়ে আসছে যে, তাদের সম্পর্ক বাংলাদেশের সঙ্গে, কোনো দল বা নেতার সঙ্গে নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো- আওয়ামী লীগের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিল নয়াদিল্লি।

১৯৭১ সালের রক্তাক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ভারতের সহায়তায় হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ভারতের জন্য পাকিস্তানের বিভাজন একটি বড় কৌশলগত ও নিরাপত্তামূলক সমাধান। 

হাসিনার সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক বেশ পুরনো। ৫০ বছর আগে, ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে তার পিতাসহ পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য নিহত হন। সে সময় তিনি প্রথম নয়াদিল্লিকে তার বাড়ি বলেছিলেন। জার্মানিতে থাকায় হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা বেঁচে গিয়েছিলেন। পরে তখন ভারতে তাদের আশ্রয় দেন দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। স্বামী এমএ ওয়াজেদ, সন্তান এবং রেহানার সঙ্গে নয়াদিল্লির একটি বাসভবনে থাকতেন হাসিনা। অল ইন্ডিয়া রেডিওর বাংলা বিভাগে কাজও করেছিলেন। ছয় বছর নির্বাসনে থাকার পর হাসিনা তার পিতার দলের নেতৃত্ব নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। 

প্রথমবার ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হন। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসেন ২০০৯ সালে। তার শাসনামলগুলোতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ফুলেফেঁপে ওঠে। তার বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে করা বিভিন্ন চুক্তি নিয়ে সমালোচিত থাকা সত্ত্বেও তিনি এ বিষয়ে ছিলেন অনড়।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর কোথায় পালাবেন এ নিয়ে তার তেমন কোনো সন্দেহ ছিল না। পালিয়ে যাওয়ার পর নয়াদিল্লির উপকণ্ঠে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল তাকে স্বাগত জানান।

সাবেক হাইকমিশনার চক্রবর্তী ২০০৯ সালে অল্প সময়ের জন্য হাসিনা সরকারের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। তিনি বলেন, আমরা এবার হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাইনি। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে গ্রহণ করেন। কারণ তিনি ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ফলে তাকে আশ্রয় দেয়া ছাড়া ভারতের কোনো বিকল্প ছিল না। চক্রবর্তীর প্রশ্ন- তিনি (হাসিনা) কি বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন? বিশেষ করে যখন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনি যোগ করেন, হাসিনা ভারতের একজন গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। ফলে ভারতকে তার বিষয়ে এখন নৈতিক অবস্থান নিতে হবে। 

ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ভারতে হাসিনার উপস্থিতি দুই দেশের ভবিষ্যৎ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কাঁটা। তবে এটি ভারতকে তার মিত্রদের প্রতি অনুগত থাকার প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকতে সাহায্য করছে।

-আল জাজিরা