বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের প্রেক্ষিতে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত বিবৃতিটি
নিছক কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া নয়; বরং এই বিবৃতির ভাষা, শব্দচয়ন ও সুর-সবকিছুই নয়াদিল্লির দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগতনীতি, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা উপলব্ধির বড় এক ইঙ্গিত বহন করে। নয়াদিল্লির বিবৃতিটি নিম্নরূপ:-
“India has noted the verdict announced by the International Crimes Tribunal of Bangladesh concerning former Prime Minister Sheikh Hasina. As a close neighbor, India remains committed to the best interests of the people of Bangladesh, including in peace, democracy, inclusion and stability in that country. We will always engage constructively with all stakeholders to that end.”
বিবৃতিটিতে যে সংযম এবং কৌশলগত ভারসাম্যের নিপুণ মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়, তা ভারতের আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক সতর্কতা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতিপথের প্রতি তাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের প্রমাণ।
বিবৃতির তিনটি কৌশলগত স্তম্ভ:
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত বিবৃতিটি তিনটি মূল স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে গঠিত, যা নয়াদিল্লির কৌশলগত অভিপ্রায়কে স্পষ্ট করে তোলে:-
১. অবগত থাকা: ভারত বাংলাদেশের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’-এর ঘোষিত রায় ‘লক্ষ্য করেছে’ বা ‘নোট করেছে’। এই ভাষা ব্যবহার করে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিচার প্রক্রিয়া থেকে কৌশলগত দূরত্ব বজায় রেখেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিধারার উপর তাদের পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রেখেছে তাও প্রকাশ করেছে।
২. শান্তি ও স্থিতিশীলতা: ভারত এই বিবৃতিতে তার কৌশলগতনীতি, শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতা’র ওপর জোর দিয়েছে এবং এটিকে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত করেছে। বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনৈতিক করিডোরের জন্য কৌশলগতভাবে অপরিহার্য।
৩. কৌশলগত ভারসাম্য : বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘We will always engage constructively with all stakeholders to that end.’’ ভারতের অঙ্গীকার ‘সকল স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে যুক্ত থাকার’। এটি ভারতের আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। এই দ্ব্যর্থবোধক বাক্যের মাধ্যমে নয়াদিল্লি একক রাজনৈতিক পক্ষ বা ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভরশীলতা ত্যাগ করে, ভবিষ্যতের যেকোনো রাজনৈতিক রূপান্তরের জন্য উন্মুক্ত চ্যানেল বজায় রাখার বার্তা প্রদান করে।
সংযত অবস্থান নাকি কৌশলগত দূরত্ব: ভারত সরাসরি রায় সমর্থন বা বিরোধিতা-কোনোটিই না করে একটি সতর্ক ‘কৌশলগত দূরত্বের’ নীতি প্রতিফলিত করেছে। একসময় শেখ হাসিনার প্রতি ভারত স্পষ্ট রাজনৈতিক সমর্থন বা তোষণনীতি অনুসরণ করলেও, এখন মৃত্যুদণ্ডের পর্যায়ে এসে ‘অবগত থাকা’র ভাষা ব্যবহার করে ভারত পূর্ববর্তী একতরফা সমর্থনের দায় কমানোর নীতি অনুসরণ করছে। এর মাধ্যমে ভারত দেখাতে চায় যে, বাংলাদেশে একটি বৈধ অভ্যন্তরীণ আইনি প্রক্রিয়া চলছে, যাতে বিরোধী অবস্থান নিলে ভারতীয় হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠতে পারে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি এসেছে ‘সব অংশীজনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে ইচ্ছুক’-এই ইঙ্গিতের মাধ্যমে। এটি স্পষ্ট বার্তা দেয় যে, ভারত আর বাংলাদেশের কোনো একক রাজনৈতিক শক্তির ওপর নির্ভর করছে না, বরং উদীয়মান নতুন ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর সঙ্গেও কাজ করতে প্রস্তুত। এটি ইঙ্গিত করে যে, অতীতের ‘দিল্লি-ঢাকা অক্ষ’ এখন বাস্তব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও হিসেবি হয়ে উঠেছে।
ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি ও ভারতের জাতীয় স্বার্থ: বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ভারতের চারটি মৌলিক কৌশলগত স্বার্থে ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। এই স্বার্থগুলো রক্ষার জন্যই নয়াদিল্লির সতর্ক প্রতিক্রিয়া:-
ক. সীমান্ত নিরাপত্তা: বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিরাপত্তাহীনতা ও সহিংস কার্যকলাপ বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
খ. মানবিক সংকট: রায়কে কেন্দ্র করে সংঘাত বাড়লে উভয় দেশে মানবিক সংকট তৈরি হতে পারে। ভারতের বিবৃতি ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতার’ ওপর জোর দেয়া এই উদ্বেগকেই প্রতিফলিত করে।
গ. ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা: চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই বাংলাদেশ প্রশ্নে আগ্রহী। ভারত চায় না যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক রূপান্তরে অন্য কোনো শক্তি প্রভাবশালী ভূমিকা রাখুক। তাই ভারত ‘Constructively engaged’ থাকার মাধ্যমে কূটনৈতিক সক্রিয়তা বজায় রাখার বার্তা প্রদান করে।
ঘ. আঞ্চলিক বাণিজ্য ও সংযোগ রাজনীতি: ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাণিজ্য এবং সংযোগ প্রকল্পের সাফল্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল।
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া মূলত একটি কৌশলগত সতর্ক অবস্থান । অতীতে যে আবেগপূর্ণ ও পক্ষপাতমূলক সম্পর্ক ছিল, তা এখন আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও হিসেবি হয়ে উঠছে।
নয়াদিল্লির কূটনৈতিক ভাষার নিপুণ মিশ্রণ:-‘We will always engage constructively with all stakeholders’- এই সতর্ক ও ভারসাম্যপূর্ণ বিবৃতিই ইঙ্গিত দেয় যে, ভারত এখন কোনো একক পক্ষের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন না দেখিয়ে বরং একটি টেকসই সমাধান চাইছে, যা কেবল বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থই নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। ভবিষ্যতের কূটনীতির জন্য এই বহুপক্ষীয় সম্পৃক্ততার ভারতীয় নীতিটিই তাদের নৈতিক অবস্থান হবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক