নানা সংকটে দেশের নারী উদ্যোক্তারা ব্যবসায় এগিয়ে আসতে পারছেন না। বাধা ঠেলে যারা এগিয়ে আসেন তাদের সংখ্যাও খুব অল্প। বাণিজ্যিক বাজারে যেসব নারী আসেন, তারাও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। ব্যবসা বাড়াতে যে অর্থের দরকার হয়, মূলধন না থাকায় অধিকাংশ নারী ব্যাংক ঋণের প্রতি ঝুঁকছেন। কিন্তু ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি পিছিয়ে রয়েছেন নারীরাই।
নারীদের ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের পুনঃঅর্থায়ন স্কিম রয়েছে। যার সুদের হার ৫ শতাংশ থেকে শুরু হয়, যেখানে সাধারণ ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ। এ ছাড়া করোনার সময়ে দেওয়া ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিলের সুদহার ৪ শতাংশ।
জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬-তে বলা হয়েছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে ঋণের ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। কিন্তু নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার হার মাত্র ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, এসএমই উদ্যোক্তাদের ২০২১ থেকে ২০২৩ অর্থবছরে ৬ লাখ ৩৫ হাজার ২৩০ কোটি টাকা ঋণ দেয় দেশের বিভিন্ন ব্যাংক। তাতে পুরুষ উদ্যোক্তারা মোট ঋণের ৯৪ থেকে ৯৬ শতাংশ পেলেও নারী উদ্যোক্তারা মাত্র ৪ থেকে ৬ শতাংশ ঋণ পেয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই স্পেশাল প্রোগ্রাম ডিপার্টমেন্টের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ব্যাংক ১ লাখ ৮৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা ঋণ দেয়। এর মধ্যে পুরুষ উদ্যোক্তারা ৯৬ শতাংশ ঋণ পেলেও নারীরা পেয়েছেন মাত্র ৪ শতাংশ। টাকার অঙ্কে মাত্র ৬ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। পরের দুই অর্থবছরে এক ও দুই শতাংশ ঋণ বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ হাজার ৩৭৪ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ শতাংশ হয়ে ১০ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা ঋণ পান নারী উদ্যোক্তারা। নারী উদ্যোক্তারা জানান, ব্যবসার জন্য নগদ অর্থ না থাকায় আগে থেকেই ব্যাংকনির্ভরতা বাড়িয়ে বিপদে পড়েছেন নারী উদ্যোক্তারা। এর মধ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে দেশে অর্থসংকট, ব্যাংক লোন না পাওয়ায় উৎপাদন ব্যহত হওয়া, আশঙ্কাজনকহারে কার্যাদেশ কমে যাওয়া ও রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা সংকট নারী উদ্যোক্তাদের খাদেও কিনারায় টেনে নিয়ে গেছে।
কনসালটেন্সি বি গ্লোবালের সিইও নাসরিন বারি বলেন, ব্যাংকগুলো অনেক বেশি সিকিউরিটি ও লিগ্যাল গ্যারেন্টার ছাড়া লোন দেয় না। পুরুষ উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া সহজ হলেও নারীদের ক্ষেত্রে এটি কোনোভাবেই সহজ না। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী সুদের হার দেওয়া থাকলেও নারী উদ্যোক্তাদের লোন দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো তা মানে না। ক্যাটেল ফিড উৎপাদনকারী সাবিনা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মার্কেটের চাহিদাসাপেক্ষে আমার ফার্মে ফিড উৎপাদনের সক্ষতা রয়েছে ১২০০ টান। চাহিদা পূরণে যে পরিমাণের কর্মী সংখ্যা দরকার তা নগদ অর্থের অভাবে নিতে পারছি না। দুটি ব্যাংক থেকে ১ কোটি টাকা লোন চেয়ে পেয়েছি মাত্র ২০ লাখ। তাতে কিছু ফিড উৎপাদনের জন্য কিছু কাঁচা মাল জোগান দিতে পেরেছি। নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করা উইমেন এন্টারপ্রেইনার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ওয়েব) সভাপতি ও এসএমই ফাউন্ডেশনের পরিচালক নাসরিন ফাতেমা আউয়াল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, লোনের ক্ষেত্রে সরকার নারীদের অগ্রাধিকার দেবে বলে দিচ্ছে না। আমরা ভেবেছিলাম, অন্তর্বর্তী সরকার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কাজ করবেন, তারাও করেনি। প্রত্যাশা করি, আগামীর সরকার কাজ করবেন। তবে আমরা নারী উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিনির্ভর করে তোলা, এসএমই মেলায় কম খরচে ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া ও তাদের নিয়ে একটি বাজার তৈরি করব। যাতে তারা নিজেদের মেলে ধরতে পারেন। পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের জন্য ট্রেনিং অত্যান্ত জরুরি। সংগঠনটির (ওয়েব) সহসভাপতি তানজিমা হোসেন মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের টিকিয়ে রাখতে হলে প্রণোদনা ও লোন দিতে হবে।
কিন্তু দুঃখজনক বিষয়, লোন নেওয়ার ক্ষোত্রে নারীরা সুবিদাবঞ্চিত থাকে। উইমেন এন্টারপ্রেইনারের তৈরি করা নারীরা ব্যবসার জন্য ১০-২০ লাখ টাকা লোন চাইলে ব্যাংকগুলো তা দিতে চায় না। যতসামান্য লোন শিক্ষিত নারীদের দিলেও তৃণমূলের নারীরা উপেক্ষিত থাকে।