ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুরে নাশকতার আশঙ্কায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। রায় ঘোষণার আগের দিন থেকেই এ চারটি জেলায় বিজিবি, র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে মাঠে নামানো হয়েছে। সম্প্রতি কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সদস্যরা বিক্ষিপ্তভাবে ককটেল বিস্ফোরণ, যানবাহনে আগুন, সরকারি স্থাপনায় হামলা ও নাশকতা চালায়। রায়কে কেন্দ্র করে দলটির এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।
এদিকে বাসে আগুন দিলে এবং ককটেল ও বোমা মেরে নগরবাসীর জীবনহানির চেষ্টা করলে নাশকতাকারীদের গুলির নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এলাকার নিরাপত্তা জোরদারে সেনা মোতায়েন করতে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সেনা সদরে চিঠি দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর ট্রাইব্যুনাল এলাকা, আদালতপাড়া, শহরের প্রবেশপথ এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাগুলোতে চেকপোস্ট, বাড়তি টহল এবং যানবাহন তল্লাশি চালানো হচ্ছে। শহরের প্রবেশমুখগুলোতে কঠোর যাচাই-বাছাই চলছে, যাতে কোনো সংগঠিত নাশকতামূলক তৎপরতা কেউ ঘটাতে না পারে।
গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর নিউ ইস্কাটন, আগারগাঁও, বিমানবন্দর, হাতিরঝিল, মিরপুর ও হাজারীবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ, গাড়িতে আগুন ও বাসে অগ্নিসংযোগের মতো বিচ্ছিন্ন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সূত্র জানায়, এ এলাকাগুলোতে বিশেষ নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যে কোনো সমন্বিত নাশকতা ঠেকাতেই এ কঠোর ব্যবস্থা। নাশকতা প্রতিরোধে রাজধানীতে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করছে ডিএমপি।
হাসিনার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে নাশকতার চেষ্টা হলে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। তিনি বলেন, কেউ বাসে আগুন দিলে, ককটেল মেরে জীবনহানির চেষ্টা করলে আইন অনুযায়ী তাকে গুলির অধিকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আছে। পুলিশের গাড়িতে আগুন দিলে, ককটেল নিক্ষেপ করলে বা জানমালের ক্ষতির চেষ্টা করলে পুলিশ তো বসে থাকবে না।’
গতকাল রোববার বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম নিশ্চিত করেন, স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধে ঢাকা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও ফরিদপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য ইউনিট, পুলিশ, র্যাব ও সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে বিজিবি অতিরিক্ত টহল ও পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করছে। বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা জানান, মূলত কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই এ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল এলাকায় সেনা মোতায়েন করতে চিঠি
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় পর্যাপ্তসংখ্যক সেনাসদস্য মোতায়েন করে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। গত শনিবার সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে সেনাসদরে এ চিঠি দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। গতকাল রোববার সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সূত্র চিঠি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও হাসিনার মামলার সংবেদনশীলতার কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় যে কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি বা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যার কারণে সোমবার পর্যাপ্তসংখ্যক সেনাসদস্য মোতায়েন করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর আগে এ মামলায় রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গত বৃহস্পতিবারও সেনা মোতায়েন করতে চিঠি দেওয়া হয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে। সে অনুযায়ী সেনাও মোতায়েন করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট ও ট্রাইব্যুনালে।
গোপালগঞ্জ-মাদারীপুর-ফরিদপুরে নাশকতার পরিকল্পনা
নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার বাইরে মধ্যাঞ্চলের তিন জেলাকে বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা, সেতু, যোগাযোগব্যবস্থা ও প্রশাসনিক অফিস লক্ষ করে নাশকতার পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, রায় ঘোষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় সহিংসতা ছড়ানোর চেষ্টা হতে পারে, যাতে জাতীয় মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়া যায়।
রায়ের পর দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে, এমন বার্তা দিতে এই জেলাগুলোর সড়ক, মহাসড়ক অবরোধ করা হতে পারে। এ অঞ্চলে বিশাল শোডাউন ও আন্দোলন হবে, যাতে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় মিডিয়ায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। টার্গেট করা হয়েছে বিদেশি মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভিডিও ও সংবাদ প্রচার করার।
পরিকল্পনাকারীরা মনে করছে, এক্ষেত্রে দেশীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিদেশি গণমাধ্যমগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা সহজ হবে। সেক্ষেত্রে বিদেশি মিডিয়া এবং এ দেশীয় গণমাধ্যমের বিভিন্ন স্থানে ফ্যাসিবাদের দোসর সংবাদকর্মীদের ধারণ করা ও প্রচার করা ভিডিওগুলো ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট ইউরোপ-আমেরিকায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে।
আওয়ামী লীগ অনলাইনে তাদের নাশকতার কর্মসূচির কথা বলছে, যা কর্মীদের একত্রিত হতে এবং নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রায় ঘোষণার পর যেকোনো আইনি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে এবং এর মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদক্ষেপ
নাশকতা প্রতিরোধে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি যৌথভাবে বেশকিছু অভিযান শুরু করেছে। চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও পলাতকদের গ্রেপ্তার অভিযান জোরদার করা হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আর্থিক লেনদেন ও ডিজিটাল যোগাযোগ নেটওয়ার্ক পর্যবেক্ষণ জোরদার করা হয়েছে। ককটেল বিস্ফোরণ থেকে শুরু করে বড় ধরনের আগুন লাগানো পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের পরিকল্পনা শনাক্ত করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে বাড়তি টহল।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে রায় ঘোষণা করা হবে এবং নির্বাচন সহিংসতামুক্ত রাখতে প্রশাসন জিরো টলারেন্স অবস্থানে রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গতকাল রোববার বরিশালে এক বৈঠক শেষে বলেছেন, ‘আগামীকাল (আজ সোমবার) ট্রাইব্যুনালে যে রায় হোক, তা কার্যকর হবে। বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে এবং সরকার দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় বদ্ধপরিকর।’
নিরাপত্তা সংস্থার সুপারিশ ও প্রস্তুতি
অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য এ পর্যন্ত গৃহীত পরিকল্পনা তেমন সাফল্যের মুখ না দেখায় এবার শেখ হাসিনার বিচারের রায় ঘোষণার সময়কে বেছে নেওয়া হয়েছে। আগাম তথ্যের ভিত্তিতে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, র্যাব ও গোয়েন্দা ইউনিটসমূহকে সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর পাশাপাশি গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও ফরিদপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়তি ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। রায় ঘোষণার পরবর্তী তিনদিন ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ সময়’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে।
নিরাপত্তা সূত্র আরো জানায়, রায়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তেজনা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। এ সুযোগে যদি কোনো সংগঠিত গোষ্ঠী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে তা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদা দুদিকেই ঝুঁকি বাড়বে। সরকারের ভেতরে কিছু অসন্তুষ্ট অংশ বা বাহিনী যদি সক্রিয় হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে। গত কয়েকটি প্রচেষ্টা সফল না হওয়ায় এবার এ রায়ের সময় নির্বাচন করা হয়েছে বলেই মনে করছেন তারা।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) এএইচএম শাহাদাত হোসেন আমার দেশকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় নজরদারি ও আগাম তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা তৎপরতা আছে। অবৈধ কর্মকাণ্ড, নাশকতা বা সংঘর্ষের চেষ্টা হলে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হবে।