রাজশাহীতে বিচারকের ছেলে তাওসিফ রহমান সুমন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার আসামি লিমন মিয়াকে পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়ায় রাজশাহী মহানগর পুলিশ (আরএমপি) কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ানকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আগামী ১৯ নভেম্বর সশরীরে হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলার একমাত্র আসামি মো. লিমন মিয়ার (৩৪) পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল শনিবার দুপুরে রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২-এর বিচারক মো. মামুনুর রশিদ এসব আদেশ দেন।
এদিকে রাজশাহী মহানগর দায়রা জজের বাসায় এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর গত শুক্রবার সারা দেশের বিচারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন দুই দফা দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করে। সব আদালতে বিচারকের বাসস্থান ও যাতায়াতের সময় নিরাপত্তা বাহিনী নিযুক্ত করা এবং রাজশাহীর ঘটনায় বিচারকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অবহেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং গ্রেপ্তার করা আসামিকে আইনবহির্ভূতভাবে মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করে অপেশাদারত্ব প্রদর্শনে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলেন তারা। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এ দাবি পূরণ না হলে আজ রোববার থেকে বিচারকদের কলমবিরতি কর্মসূচির ডাক দেয় অ্যাসোসিয়েশন।
তবে এরই মধ্যে বিচারকদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা। জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম শনিবার সন্ধ্যায় কালবেলাকে বলেন, আইন উপদেষ্টার সঙ্গে বিচারকদের বৈঠক হয়েছে। তিনি আমাদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। রাতেই অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির সভায় এ কর্মসূচির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।
‘আরএমপি কমিশনারকে তলব’
গতকাল শনিবার রাজশাহী সিএমএম আদালতের বিচারক হামিদুর রহমান আরএমপি কমিশনারকে তলব করে নোটিশ জারি করেন। মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আলী আশরাফ মাসুম জানান, জারি করা কারণ দর্শানোর নোটিশে পুলিশ কমিশনারকে আগামী ১৯ নভেম্বরের মধ্যে আদালতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। আরএমপি কমিশনারকে তলবের আদেশে বলা হয়েছে, মিডিয়ায় প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদ থেকে অত্র আদালতের গোচরীভূত হয়েছে যে, গত ১৩ নভেম্বর মোহাম্মদ আব্দুর রহমান, মহানগর দায়রা জজ, রাজশাহীর রাজপাড়া থানাধীন তেরখাদিয়া এলাকাস্থ ডাবতলা নামক স্থানের ১০ তলাবিশিষ্ট ‘স্পার্ক ভিউ’ অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের পঞ্চম তলার 5A নম্বর ভাড়া ফ্ল্যাটে অভিযুক্ত লিমন মিয়া কৌশলে প্রবেশ করে তার নাবালক পুত্র তাওসিফ রহমানকে (১৭) ধারালো ছুরি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে উপর্যুপরি আঘাত ও শ্বাসরোধে মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং তার স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসিকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করে গুরুতর জখম করে। তদপরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাস্থল থেকে অভিযুক্ত লিমন মিয়াকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে দেখা যায়, ওই অভিযুক্ত লিমন মিয়া পুলিশি হেফাজতে থাকাবস্থায় বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ভিকটিমকে দোষারোপ করে বক্তব্য প্রদান করে, যা আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি বনাম রাষ্ট্র ৩৯ বিএলডি ৪৭০ সহ বিভিন্ন মামলায় প্রদত্ত মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
এমন অবস্থায়, পুলিশ হেফাজতে থাকাবস্থায় ভিকটিমকে দোষারোপ করে মিডিয়ার সামনে বক্তব্য প্রদানের সুযোগ প্রদান করায় কেন মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান, পুলিশ কমিশনার, আরএমপি, রাজশাহী, আপনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা আগামী ধার্য তারিখের মধ্যে সশরীরে অত্র আদালতে হাজির হয়ে কারণ দর্শানোর জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো। আগামী ধার্য তারিখ ১৯ নভেম্বর।
‘একমাত্র আসামির পাঁচ দিনের রিমান্ড’
রাজশাহীতে মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আব্দুর রহমানের বাসায় ঢুকে তার ছেলে তাওসিফ রহমানকে (১৫) হত্যা ও স্ত্রীকে হত্যাচেষ্টার মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া একমাত্র আসামি মো. লিমন মিয়ার (৩৪) পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। শনিবার দুপুরে রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২-এর বিচারক মো. মামুনুর রশিদ এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আরএমপির মুখপাত্র ও উপকমিশনার মো. গাজিউর রহমান জানান, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজপাড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আসাদুল ইসলাম আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
তিনি আরও বলেন, শনিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসাধীন লিমন মিয়াকে হাসপাতাল ত্যাগের অনুমতি দেয়। পরে তাকে আদালতে হাজির করে আদালতের হাজতে রাখা হয়। দুপুর ২টার দিকে তাকে আদালতে তোলা হয়। রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ায় তাকে রাজপাড়া থানায় নেওয়া হয়েছে, যেখানে এ চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) তেরখাদিয়া ডাবতলা এলাকায় অবস্থিত বিচারকের বাসায় আকস্মিক প্রবেশ করে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বাসিন্দা লিমন মিয়া। সে ছুরিকাঘাত ও শ্বাসরোধে বিচারকের ছেলে তাওসিফ রহমানকে হত্যা করে। এ সময় তার ছুরিকাঘাতে বিচারকের স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসি (৪৪) আহত হন। ধস্তাধস্তির সময় লিমন মিয়াও আহত হয় এবং পরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরের দিন শুক্রবার বিচারক মোহাম্মদ আব্দুর রহমান নিজে বাদী হয়ে রাজপাড়া থানায় হত্যা মামলা করেন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, পূর্বপরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে লিমন মিয়া।
এদিকে এ ঘটনার পর আসামি লিমন মিয়ার সাক্ষাৎকারের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে সে দাবি করে, বিচারকের স্ত্রীর সঙ্গে তার পাঁচ বছরের পরকীয়া সম্পর্ক ছিল। আর সে সম্পর্ক ঘিরে তৈরি হওয়া বিরোধ থেকে ঘটে এ হত্যাকাণ্ড। তবে হত্যার কয়েকদিন আগেই ঘাতক লিমনের হুমকিতে সপরিবারে নিরাপত্তা শঙ্কার কথা জানিয়ে থানায় জিডি করেছিলেন মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আবদুর রহমানের স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসি।
গত ৬ নভেম্বর সিলেটের সুরমা থানায় দাখিল করা জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে লিমন মিয়ার সঙ্গে তার পরিচয়। লিমন দরিদ্র হওয়ায় তাকে আর্থিক সহায়তা করতেন। এখন টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই লিমন তাকে সপরিবারে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। গত ৩ নভেম্বর তাকে সপরিবারে হত্যার হুমকি দেয় লিমন।
জিডির ঠিক ছয় দিন পর বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) বিকেলে রাজশাহীতে ভাড়া ফ্ল্যাটে লিমনের হাতে খুন হয় বিচারকের ছেলে তাওসিফ রহমান সুমন (১৭)। সুমন সরকারি ল্যাবরেটরি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল। ঘটনার সময় আহত হয়েছেন তার স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসি ও ঘাতক লিমন মিয়া। লুসিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন লিমনকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।