যশোর সদর উপজেলার রুদ্রপুরের মাহিদিয়া সম্মিলনী মহিলা আলিম মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগে ভয়ংকর জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ। গত ২ নভেম্বর কালবেলায় ‘সমাজকর্মে পড়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক: স্নাতকের আগেই স্নাতকোত্তর’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হলে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ।
মাদ্রাসা অধিদপ্তরের প্রশাসন ও অর্থ শাখার পরিচালক মুহাম্মদ মাহবুবুল হককে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন—প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন শাখার পরিচালক আবুল কালাম তালুকদার এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের উপসচিব (মাদ্রাসা-১) রাহাত মান্নান। কমিটি গত বুধবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেছে।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় ডেকে চারজন অভিযুক্ত শিক্ষককে জিজ্ঞাসাবাদ করে কমিটি। একই সঙ্গে মাদ্রাসা অধিদপ্তরের অর্থ শাখার উপপরিচালক ড. কে এম শফিকুল ইসলাম এবং অডিট ও আইন শাখার সহকারী পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেনকে ডাকা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় কমিটি চারজন শিক্ষকের বেতন-ভাতা ছাড়ার জন্য ব্যবহৃত ফাইল দেখতে চাইলে অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা কোনো নথি উপস্থাপন করতে পারেননি। একপর্যায়ে দুজনই পরস্পরের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেন। উপপরিচালক শফিকুল ইসলাম দাবি করেন, সহকারী পরিচালক সব কিছু প্রস্তুত করে তার কাছে পাঠান, তিনি শুধু সই করেছেন। অন্যদিকে সহকারী পরিচালক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমি এ ফাইল সম্পর্কে কোনো কিছু জানি না।’
অধিদপ্তরের একটি সূত্র কালবেলাকে জানায়, অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা চার শিক্ষকের সম্পূর্ণ ফাইল গায়েব করেছেন, যাতে তদন্তের সময় কোনো নথিই উদ্ধার করা না যায়। তবে তদন্ত কমিটি বিকল্প উৎস থেকে সে ফাইল সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বদলি না করায় তারা তদন্ত কমিটিকে প্রভাবিত করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত ২ নভেম্বর কালবেলায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ওই মাদ্রাসার তিনজন শিক্ষক স্নাতকোত্তর করেছেন সমাজকর্মে, আর প্রভাষক হয়েছেন রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও উদ্ভিদবিজ্ঞানে। তাদের একজন আবার স্নাতক পাসের দুই বছর আগেই স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। আরেকজন নিজের বাল্যবন্ধুর নাম-পরিচয় ও সব সনদপত্র চুরি করে হয়েছেন গণিতের প্রভাষক। নামের মিলে এক নারী শিক্ষক চাকরি করছেন আরেক নামে। পুরুষের নিবন্ধন সনদে শিক্ষক হয়েছেন একজন নারী।
সবচেয়ে বড় জালিয়াতি করেন মাদ্রাসা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাই। ২০২৩ সালের তদন্তে ছয়জন শিক্ষকের নিয়োগে জালিয়াতির প্রমাণ পেয়ে অধিদপ্তর তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করে এবং গণিতের প্রভাষক তরিকুল ইসলামের ইনডেক্স নম্বর বাতিল করে ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করে। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পরিবর্তনের পর অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা রহস্যজনকভাবে ছয়জনের মধ্যে চারজনের নিয়োগকে ‘বৈধ’ ঘোষণা করে ফের তাদের বেতন-ভাতা চালু করে দেন। এ ঘটনায় অর্ধকোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। বাকি দুজনের ক্ষেত্রে আর্থিক সমঝোতা না হওয়ায় তাদের বেতন বন্ধই রয়ে গেছে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মাহবুবুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা তদন্তের কাজ শুরু করেছি। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আরও কিছু প্রক্রিয়া শেষে দ্রুত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’
কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পুরো ঘটনাটি তদন্তে কমিটি করেছি। প্রতিবেদনে যাদের নাম আসবে, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব।’
মাহিদিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ফারুক হোসাইন জানান, কমিটি চারজন শিক্ষকের নিয়োগপত্রসহ সব কাগজপত্র চেয়েছে। শিক্ষকরা সঙ্গে না আনায় সেগুলো জমা দেওয়া যায়নি। আজ রোববার তিনি নিজে সেসব নথিপত্র অধিদপ্তরে জমা দেবেন।