Image description

অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হওয়ার কথা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। ভোটে অংশ নিতে এরই মধ্যে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ঘোষণা করা শুরু করেছে দলীয় প্রার্থী তালিকা। বহুল আকাঙ্ক্ষিত এই ভোট উৎসব আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পাশাপাশি সরকারের কেন্দ্রীয় ও মাঠ প্রশাসনও শুরু করেছে প্রস্তুতি। যার অংশ হিসেবে নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা মাঠ প্রশাসনের জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং বিভাগীয় কমিশনার পদায়নের কাজ প্রায় শেষ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অবশ্য মাঠ প্রশাসনে বর্তমানে কর্মরত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) আপাতত প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। জনপ্রশাসনের গত কয়েকদিনের কার্যক্রমের চিত্র থেকে এমন আভাস মিলেছে।

কর্মকর্তারা জানান, এখন যারা মাঠ প্রশাসনে পদায়ন পাচ্ছেন, তারা আগামী নির্বাচনের দায়িত্ব সামলাবেন। নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকবেন ডিসিরা। সেক্ষেত্রে তার ওপর গুরু দায়িত্বই থাকবে। এজন্য ডিসি নিয়োগে বর্তমান প্রশাসন বেশ সতর্ক অবস্থান নিয়েছিল। তবুও বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হয়নি। কয়েকজন ডিসি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া কয়েকজন বিগত সরকারের সময় ভালো ভালো দপ্তর বা সংস্থায় পদায়নে ছিলেন। তারা গত সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে বাড়তি সুবিধা পেয়েছিলেন বলেও অভিযোগ। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এসব অভিযোগ স্বীকার করতে চাইছে না। তাদের ভাষ্য, ‘ব্যাপক’ যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে এবার ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

অবশ্য ডিসি হতে পারেননি এবং অতীতে বঞ্চিত ছিলেন বলে দাবি এমন কর্মকর্তারা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্য দিয়ে অনেকেই ডিসি হয়েছেন। তারা সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করতে সক্ষম হয়েছেন। যদিও ‘সংশ্লিষ্ট তারা’ কারা—এমন প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর মেলেনি বঞ্চিতদের কাছ থেকে।

নিয়োগ প্রজ্ঞাপন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ৮ ও ৯ নভেম্বর ২৯ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। চার দিন পর তাদের থেকে দুজনের নিয়োগ বাতিল করা হয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই তাদের নিয়োগ বাতিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ৮ নভেম্বর সিলেট জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সন্দ্বীপ কুমার সিংহকে বরগুনার ডিসি হিসেবে পদায়ন দেওয়ার পর ১৩ নভেম্বর তার নিয়োগ বাতিল করা হয়। এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা চলছে—এমন তথ্যের ভিত্তিতে তার নিয়োগ বাতিল হয়। এ ছাড়া ৯ নভেম্বর মেহেরপুরে ডিসি নিয়োগ পাওয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মিজ লুৎফুন নাহারের নিয়োগাদেশও বাতিল করা হয়। তবে তার নিয়োগ বাতিলের বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা যায়নি।

জনপ্রশাসনের প্রজ্ঞাপনে দেখা গেছে, কয়েকটি জেলার ডিসিকে নিয়োগের মাত্র কয়েকদিনের মাথায় অন্য জেলায় বদলি করা হয়েছে। অতিমাত্রায় সতর্কতার অংশ হিসেবে এসব বদলির ঘটনা ঘটছে বলে ধারণা কর্মকর্তাদের।

গত ১৩ নভেম্বর নতুন করে আরও ২৩ জেলায় ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ২২ জনই নতুন করে ডিসি হয়েছেন। আর একজনের জেলা বদল করা হয়েছে। এসব নিয়োগের মধ্য দিয়ে প্রায় সব জেলায়ই ডিসি নিয়োগের কার্যক্রম শেষ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। নতুন করে কাউকে প্রত্যাহার করা হলে সেখানে নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

নির্বাচন মাথায় রেখে একই দিন নতুন করে চার বিভাগে বিভাগীয় কমিশনারও নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তারা আগামী নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবেন। নতুন কমিশনারদের মধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. এ এন এম বজলুর রশিদকে রাজশাহী, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমানকে বরিশাল এবং বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান ফারাহ শাম্মীকে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার মোখতার আহমেদকে খুলনার বিভাগীয় কমিশনার পদে বদলি করা হয়েছে। তবে বর্তমানে কর্মরত ইউএনওদের আপাতত বদলি কিংবা প্রত্যাহারের কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র।

প্রশাসন বিশ্লেষক ও সাবেক সচিব এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘নির্বাচনে ডিসি-ইউএনওদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তাদের আমি পায়োনিয়ার (পথিকৃৎ) বলি। তারা যদি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে পুলিশ তার দায়িত্ব ঠিকঠাকভাবে পালনে বাধ্য থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘জেলায় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ডিসিরা যদি প্রচুর পরিমাণে মোটিভেশনাল মিটিং করতে পারেন, তাহলে সাধারণ মানুষ সচেতন হওয়ার সুযোগ পাবে। এমনকি ভোটের সঙ্গে যুক্ত অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সচেতন হবেন। সুষ্ঠু ভোট আয়োজনের ক্ষেত্রে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগে ইউএনওদের খুবই সচেতন হতে হবে। যারা প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার হবেন, তারা যেন নিরপেক্ষ হন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে যেসব কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ, সেসব কেন্দ্রে বাড়তি নজর দিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডিসি-ইউএনওদের সততা দৃশ্যমান হতে হবে। যেন জনসাধারণের পাশাপাশি প্রার্থীরাও তাদের অনৈতিকভাবে চাপ দিতে না পারেন। সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’

ভোটের দিন পুলিশ, আনসার, চৌকিদারসহ যারা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করবেন তারা যেন কারও বাড়িতে আপ্যায়ন গ্রহণ না করেন, সেটি নিশ্চিতের তাগিদ দিয়ে সাবেক এই সচিব বলেন, তাহলে কর্মকর্তাদের সুনাম অক্ষুণ্ন থাকবে।

২০ ডিসি প্রত্যাহার: নতুন ডিসি নিয়োগের উদ্দেশ্যে মাঠে কর্মরত ২০ ডিসিকে প্রত্যাহার করেছে জনপ্রশাসন। গত ১৩ নভেম্বর তাদের প্রত্যাহার করা হয়। তারা সবাই উপসচিব। সরকার চাইলে এই কর্মকর্তারা আগামী নির্বাচনকালীন ডিসি হিসেবে মাঠে থাকতে পারতেন। সাধারণত উপসচিবরা ডিসি নিয়োগের পর যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পর্যন্ত মাঠ প্রশাসনে ডিসি হিসেবে চাকরির সুযোগ পান। এই ২০ ডিসিকে প্রত্যাহারের পর সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগে পদায়ন করা হয়েছে।

ভয় থেকে সতর্কে ডিসিরা: ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের একতরফা নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী ডিসিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসন। তাদের অনেককেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের জনপ্রশাসনে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি করে রাখা হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে যেমন হতাশা কাজ করছে, তেমনি এ সরকারের আমলে নতুন ডিসি হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে ভয় কাজ করছে। কারণ, নির্বাচনে ভালো-মন্দ যাই হোক—তার দায় ডিসিদের ঘাড়েই পড়ে। গত তিনটি নির্বাচনের দায়দায়িত্ব পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ঘাড়েই পড়েছে। এজন্য এখনকার ডিসিরা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার বিষয়ে সতর্ক রয়েছেন বলে জানিয়েছেন তাদের অনেকে। এ ছাড়া বারবার সিদ্ধান্ত বদল করে নিয়োগ ও বদলির ঘটনায় কর্মকর্তারা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। তারা বলছেন, এরই মধ্যে অনেক নিয়োগ বাতিল হয়েছে। সুতরাং ডিসি নিয়োগ পাওয়ার পরও তারা স্বস্তিতে নেই।

এসপি-ওসি পদেও আসছে রদবদল: ভোটের সময় মাঠে পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বলে বিবেচনা করা হয়। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ব্যালট বক্স সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। এসব বিবেচনায় নিরপেক্ষ প্রশাসনের অংশ হিসেবে পুলিশেও রদবদলের দিকে এগোচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সূত্র জানায়, নির্বাচনের অংশ হিসেবে পুলিশ সুপার (এসপি) এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে নিয়োগপ্রত্যাশীদের বাছাইয়ের কাজ চলছে। তাদের নির্বাচনের আগে লটারির মাধ্যমে বদলি-পদায়নের চিন্তা করছে সরকার।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এরই মধ্যে জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগে এসপি-ওসির পদায়ন হবে লটারির মাধ্যমে। তবে এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি ওঠার পর তা বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, ৬৪ জেলার এসপিদের কর্মদক্ষতা যাচাই চলছে। এদের মধ্যে যারা যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন, তাদের নির্বাচনের মাঠে রাখা হবে। যারা মূল্যায়নে বাদ পড়বেন, তাদের প্রত্যাহার করা হবে। অবশ্য এসব বিষয় নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা।

বর্তমানে বিসিএস ২৫ ও ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তারা এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ভোটের আগে ২৫ ব্যাচের অনেককে প্রত্যাহার করে তাদের স্থলে ২৮ ব্যাচ থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছিলেন, গত তিনটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছেন—এমন পুলিশ কর্মকর্তাদের এবারের ভোটে দায়িত্বে রাখা হবে না।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানান, এসপি নিয়োগে প্রস্তুতি চলছে। শিগগির তারা নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করতে পারবেন। এসপি পদে লটারির মাধ্যমে নিয়োগ পদায়ন প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যেভাবে বলবে সেভাবে হবে।